এস. আলম গ্রুপের চিনির বর্জ্য কর্ণফুলীতে মিশে মারা গেছে বিপুলসংখ্যক জলজ প্রাণী
2024.03.07
ঢাকা

দেশের অন্যতম বড় শিল্পগ্রুপ এস. আলমের বিরুদ্ধে কর্ণফুলী নদীতে গুদামের পোড়া চিনি ফেলে নদী দূষণের অভিযোগ উঠেছে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নদীতে দূষণের কারণে এখন পর্যন্ত ১১ প্রজাতির মাছ ও কাঁকড়া মারা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠলেও পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
তবে বৃহস্পতিবার থেকে নদীতে পোড়া বর্জ্য ফেলা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বুধবার অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাসকে ফোন করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলে নড়েচড়ে বসে অধিদপ্তর।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফাহমিদা খাতুন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এস. আলম গ্রুপের গুদামে আগুন লাগার পরে অপরিশোধিত চিনির একটি বিরাট অংশ নদীতে পড়েছে। স্যার (সাবের হোসেন চৌধুরী) নদীতে দূষিত পদার্থ ফেলা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পরে গতকাল থেকেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। বর্জ্য আর যেন কর্ণফুলীতে না পড়ে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
“এখন বড় বড় গর্ত করে নিচে পলিথিন বিছিয়ে বর্জ্য রেখে মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে, যাতে ভূগর্ভস্থ দূষণ না হয়,” বলেন তিনি।
নদীতে কী পরিমাণ বর্জ্য গেছে সেটি নির্ধারণ করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন করে অধ্যাপককে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
ফাহমিদা বলেন, “এই কমিটি ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। তার ভিত্তিতে এস. আলম গ্রুপের কাছ থেকে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে।”
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ অগ্নি নিয়ন্ত্রণে কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কফিল উদ্দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেনারকে বলেন, “সোমবার বিকেলে আগুন লাগে এবং বৃহস্পতিবার সকালে তা নিয়ন্ত্রণে আসে।”
তবে বৃহস্পতিবার রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নেভেনি।
সুগার মিলটির পাশে অপরিশোধিত চিনি রাখার পাঁচটি গুদাম ছিল। যে গুদামটিতে আগুন লেগেছে, তাতে ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি ছিল বলে মিল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে।
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীতে চিনির গলিত পানি মিশে পানি এখন কালচে বর্ণ ধারন করেছে। বুধবার সকাল থেকে মরা মাছ ভাসতে শুরু করে। টেংরা, কাঁকড়া, কাঁচকি, চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ ও জলজ প্রাণী মরে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে ভাসছিল। কিছু ভাসছিল আধমরা অবস্থায়। স্থানীয় লোকজন মাছগুলো সংগ্রহ করতে নেমে পড়েন নদীতে।

পোড়া চিনি নদীতে, যে ক্ষতি হতে পারে
অগ্নিকাণ্ডে পোড়া চিনি কর্ণফুলী নদীতে পড়ায় দূষণের মাত্রা ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “অপরিশোধিত চিনি পুড়ে সেই বর্জ্য অ্যাসিড নাকি ক্ষারে রূপান্তরিত হচ্ছে সেটি পরীক্ষা করা দরকার।”
তিনি বলেন, “পাতা বা কোনো জৈব পদার্থ পড়লে অথবা মিশ্রিত হলে সেটি পচাতে পানির অক্সিজেন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এতে পানিতে থাকা অক্সিজেনের একটি বড় অংশ ওই জৈব পদার্থে চলে যায়, ফলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কমে যায়।
“চিনি একটি জৈব পদার্থ, অপরিশোধিত চিনিও জৈব পদার্থ। এর মধ্যে চিটা গুড়সহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থাকে। যে কারণে অক্সিজেন স্বল্পতায় মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে,” বলেন রেজাউল।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, এস. আলম গ্রুপের চিনির কারখানায় অগ্নিকাণ্ড দুঃখজনক।
তিনি বলেন, “কর্ণফুলী নদী আমাদের দেশের প্রাণ। কর্ণফুলী নদীতে দেশের প্রধান বন্দর অবস্থিত। এটি বুড়িগঙ্গা নদী নয়। এই নদী শেষ হলে বাংলাদেশ শেষ হয়ে যাবে—এটি মনে রাখতে হবে। তাই যে কোনো মূল্যে হোক কর্ণফুলী নদী রক্ষা করতে হবে।”
আলম বলেন, “যা হয়েছে তা দুর্ঘটনা। ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এখানে ব্যবসায়ীদের বলার কিছু নেই।”
দুর্ঘটনার হলেও নদী দূষণ অপরাধ: বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) আইনজীবী হাসানুল বান্না বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এস. আলম গ্রুপের গুদামে আগুন লেগেছে। এটি একটি দুর্ঘটনা বলা যায়। তবে এই দুর্ঘটনার ফলে নদী দূষণ এবং মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণীর যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি অপরাধ।”
বান্না জানান, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এবং বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ অনুযায়ী মাত্রা ভেদে নদী ও পানি দূষণের শাস্তির বিধান রয়েছে। এই দুই আইন অনুযায়ী, এই অপরাধে দায়ী ব্যক্তিকে দুই থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর অথবা দুই লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
“প্রতিবেশের কোনো ক্ষতি হলে সে জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে,” বলেন বান্না।