সাগরপথে মানব পাচার: অবৈধ অভিবাসীদের শাস্তির সুপারিশ
2021.08.12
ঢাকা

অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাই যারা এভাবে অবৈধ উপায়ে বিদেশ যাবে, তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির বিধান করতে সুপারিশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
স্থায়ী কমিটির গত ১১ জুলাইয়ের সভায় এই সুপারিশ করা হলেও বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির ওই সভার কার্যবিবরণীতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনো অবৈধ অভিবাসীকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা নেই। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩ অনুযায়ী কোনো বাংলাদেশি বিদেশে বিপদে পড়লে দেশে ফেরা তাঁর অধিকার।
কোনো বাংলাদেশিকে অবৈধভাবে বিদেশে পাঠালে অথবা কোনো বাংলাদেশিকে বিদেশে বিপদগ্রস্ত করা হলে সেই রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে জেল–জরিমানার বিধান রয়েছে এই আইনে।
সংসদীয় কমিটি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসীদের শাস্তি দিতে হলে ওই আইন সংশোধন করতে হবে।
আইন ও শাস্তির বিষয়টি নিয়ে এই আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি, বাংলাদেশি নাগরিকদের মৃত্যু বা উদ্ধার হওয়ার ঘটনাগুলো।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাবে, গত বছর মানব পাচারের শিকার হওয়া এক হাজার ৪৭৩ জন বাংলাদেশিকে তিউনিশিয়া ও লিবিয়া থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আর এ বছর জুনে ২৬৪ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে ভূমধ্যসাগরীয় দেশ তিউনিশিয়ার কোস্ট গার্ড।
আইওএম আরও জানায়, ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত সংস্থাটির সহায়তায় ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে মানব পাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান। এ সময় ১১ জুলাই সভার সুপারিশ অনুযায়ী বুধবার পর্যন্ত কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে বৃহস্পতিবার একটি কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়।
বেনারের হাতে আসা ওই কার্যপত্রে দেখা যায়, ১১ জুলাইয়ের বৈঠকের পর সমুদ্রপথে অবৈধ উপায়ে বিদেশগমন রোধ করতে ১৪ জুলাই ‘লিবিয়া-তিউনিশিয়ায় উদ্ধারকৃত বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রত্যাবাসন এবং ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ’ শিরোনামে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা যোগ দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবারের কার্যপত্রে জানায়, বাংলাদেশি নাগরিকেরা যাতে সহজে দুবাই থেকে লিবিয়ার বেনগাজী শহর পর্যন্ত না যেতে পারে, সে ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
আরেক সুপারিশে বলা হয়, মানব পাচারে জড়িত অপরাধীদের বিশেষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
অবৈধ অভিবাসনে ‘দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে’
বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি স্থায়ী কমিটির ১১ জুলাই সভায় উপস্থাপন করেন কমিটির সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স।
তিনি বলেন, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ গমন যেতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষ মারা যাচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছে; এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
অবৈধপথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান প্রিন্স।
জবাবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “করোনাকালীন সময়ে অবৈধ পথে বিদেশ গমনের প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা হয়েছে এবং খুব দ্রুত একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
তিনি বলেন, “এভাবে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধে পাচারকারী ও পাচার হওয়া ব্যক্তিকে দেশে এনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
গত বছর লিবিয়ার উপকূলে অনেক অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীর সলিল সমাধি হয় এবং সেখান থেকে ৪২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে দেশে ফেরত আনা হয়েছিল বলে সভায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে আব্দুল মোমেন।
বৈঠকের সভাপতি ফারুক খান বলেন, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশগমন রোধকল্পে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় যৌথ কমিটি করে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করতে পারে।
এর পাশাপাশি আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরত এনে রিমান্ডে নিয়ে তথ্য সংগ্রহপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে বলেও মতামত দেন তিনি।
অভিবাসীদের শাস্তি ‘গ্রহণযোগ্য নয়’
“আমাদের দেশ থেকে অনেকেই সমুদ্রপথসহ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
তবে প্রতি বছর কত সংখ্যক বাংলাদেশি এভাবে ইউরোপে যাত্রা করেন তা সব সময় বলা সম্ভব হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা যখন বিদেশে ধরা পড়েন, উদ্ধার হন, অথবা মারা যান তখন আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জানতে পারি।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মানব পাচারকারীরা বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রথমে বিমানে করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই নিয়ে যায়। সেখান থেকে লিবিয়ার সমুদ্র উপকূলীয় শহর বেনগাজী নেওয়া হয়। সেখান থেকে প্লাস্টিকের হালকা নৌকায় চেপে গন্তব্য হয় ইতালি, গ্রিস ও স্পেন।
এই যাত্রায় অনেকেই সফল হয়; আবার অনেকেই ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে মারা যায়। অনেকেই তিউনিশিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করেন বলেও জানান কর্মকর্তারা।
সভাপতি ফারুক খান বেনারকে বলেন, “আমরা এই সুপারিশ করার কারণ হলো, এটি কার্যকর করা হলে মানুষের মধ্যে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমবে।”
তবে, এই সুপারিশ নিয়ে ভিন্নমত সংশ্লিষ্টদের। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় অভিবাসীদের শাস্তি দেয়ার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।
গত ১৯ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে এক সভায় শাস্তির এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “ওই সভায় অংশীজনেরা এক হয়ে প্রস্তাবিত এই সংশোধনের বিরোধিতা করি।”
প্রস্তাবের বিরোধিতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “যদি অভিবাসীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় তাহলে রিক্রুটিং এজেন্সি সংশ্লিষ্টদের আর শাস্তি দেয়া যাবে না। সব সময়ই ব্যক্তিদের দায়ী করা হবে।”