মহাকাশে উৎক্ষেপণের অপেক্ষায় দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’

পুলক ঘটক
2018.05.09
ঢাকা
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের নমুনা, যেটি বৃহস্পতিবার মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে। ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইটের নমুনা, যেটি বৃহস্পতিবার মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে। ফাইল ছবি।
বেনারনিউজ

মহাকাশে কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ প্রেরণের মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে বাংলাদেশ। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে বৃহস্পতিবার রাতের শেষ প্রহরে অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় ৪টা ১২ মিনিটে মহাকাশে ডানা মেলবে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট “বঙ্গবন্ধু-১”।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) ইতিমধ্যে দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে গেলে নিজস্ব স্যাটেলাইটের অধিকারী বিশ্বের ৫৭ তম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটবে।

এর আগে কমপক্ষে ছয়বার স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তারিখ পরিবর্তন হয়।

এরপরও কয়েকদফা তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে ১০ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মহাকাশ যাত্রা শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়। এই তারিখেই স্যাটেলাইটটি আকাশে উঠবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশ এবং উৎক্ষেপণের দায়িত্ব পাওয়া মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স।

“এই স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এর ফলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিগত সেবায় অন্য দেশের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমবে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম।

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও সার্কভুক্ত সব দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ এ স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে।

দেশের প্রথম এ স্যাটেলাইটটি তৈরিতে খরচ ধরা হয় ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এ ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।

তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বেনারকে বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এই স্যাটেলাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পেশাদার ব্যক্তিদের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। আমলাদের ওপর রাখলে এই প্রকল্প আদমজী জুট মিলের পরিণতি লাভ করবে।”

ফ্রান্সের কান টুলুজ ফ্যাসিলিটিতে নির্মিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ইতিমধ্যে ফ্রান্স থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় কার্গো বিমানে করে উৎক্ষেপণস্থল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর ক্যাপ ক্যানাভেরালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফ্রান্সের থেলেস এলেনিয়া স্পেস নামক একটি স্যাটেলাইট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করেছে। এটি মহাকাশে পৌঁছে দেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেটের একটি নতুন সংস্করণ।

২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, স্যাটেলাইটের কাঠামো, উৎক্ষেপণ-ব্যবস্থা, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনা সহায়তা ও ঋণের ব্যবস্থা করবে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।

স্যাটেলাইটটি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। জনবল ১৮ জন প্রকৌশলীসহ ৩৫ জনের মতো। ভূমি থেকে উপগ্রহটি নিয়ন্ত্রণের জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) নিজস্ব জমিতে দুটি ‘গ্রাউন্ড স্টেশন’ নির্মাণ করা হয়েছে।

উদ্‌যাপন প্রস্তুতি

বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সময়কে স্মরণীয় করে রাখতে সফল উৎক্ষেপণের পর রাজধানীর উল্লেখযোগ্য এলাকায় আতশবাজির উৎসব শুরু হবে। এ ছাড়া থাকবে ডিজিটাল আলোকসজ্জার প্রস্তুতি। একই সঙ্গে সব জেলায়ও এ উপলক্ষে উৎসব হবে। সব মিলে অনুষ্ঠান আয়োজনে ১৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।

উৎক্ষেপণস্থল ফ্লোরিডায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সরকারের ৪২ সদস্যর একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত থাকবেন।

তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ ৩০ সদস্যের একটি দল ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।

বিটিভি বৃহস্পতিবার রাত ২টা থেকে উৎক্ষেপণ প্রস্তুতিসহ সার্বিক বিষয় সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করবে।

কয়েক সপ্তাহ পর কার্যকর

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ সফল হওয়ার পর কক্ষপথে গিয়ে কার্যকর হয়েছে কিনা বুঝতে কয়েক সপ্তাহ লাগবে বলে জানিয়েছেন বিসিএসবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলা।

সফল উৎক্ষেপণ হলে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) সেবা, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সম্প্রচার এবং ইন্টারনেট সুবিধাসহ ৪০টি সেবা দিতে পারবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি দেশে ব্যবহারের জন্য এবং ২০টি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার পরিকল্পনা রয়েছে।

“সমগ্র বাংলাদেশের স্থল ও জলসীমায় নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচারের নিশ্চয়তা থাকবে। বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে ১৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। এরপর এই টাকা আর ব্যয় হবে না,” বলেছেন সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগে টেরেস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা বহাল রাখবে, দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে।”

প্রযুক্তিবিদ আবু সাঈদ খান বলেন, “উৎক্ষেপণের পর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে স্যাটেলাইটের তরঙ্গ বিক্রি করতে না পারলে পুরো প্রকল্প বৃথা যাবে। প্রকল্প সফল করতে নগদ প্রণোদনা না দিয়ে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ওপর ট্যাক্স না বসিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।