রোহিঙ্গা প্রতিবন্ধীদের চাহিদা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত: এইচআরডব্লিউ

শরীফ খিয়াম
2018.09.26
ঢাকা
180926_Rohingya_disability_1000.JPG সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া সরঞ্জামের সাহায্যে হাঁটার চেষ্টা করছেন মেগা-ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নারী। ১০ জুন ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

বাংলাদেশের কক্সবাজারে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য গড়ে ওঠা জনাকীর্ণ মেগা-ক্যাম্পে প্রতিবন্ধীদের ঝুঁকির মাত্রাটা অনেক বেশি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) ওয়েবসাইটে সোমবার প্রকাশিত এক তথ্যচিত্র এমনটা জানিয়েছে। সেখানে সংস্থার শরণার্থী অধিকার বিভাগের পরিচালক বিল ফ্রিলিক বলেন, “এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা প্রতিবন্ধীদের চাহিদা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।"

এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “শুধু মেগা-ক্যাম্প নয়, প্রতিটি শিবিরের প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা প্রতিবন্ধী রয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। তবে গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে আট হাজার ৪৩৮ জন প্রতিবন্ধী রোহিঙ্গার অবস্থান চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)।

সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালীর মেগা-ক্যাম্পের প্রতিটি ক্যাম্পে প্রতিবন্ধী রোহিঙ্গা রয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে নয়টি ক্যাম্পে তিন শতাধিক প্রতিবন্ধী রয়েছে। ক্যাম্পের বাইরে থাকা ৪৯টি রোহিঙ্গা পরিবারেও ন্যূনতম একজন প্রতিবন্ধী থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে তারা।

যদিও আরআরআরসি বলেন, “প্রাথমিক হিসেবে মোট প্রতিবন্ধী রোহিঙ্গার সংখ্যা চার শতাংশ ধারণা করা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক এক জরিপে আমরা দেখেছি, এর সংখ্যা দেড় শতাংশের বেশি নয়।”

“বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিও’র মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে,” যোগ করে তিনি জানান, বিভিন্ন সহায়ক সরঞ্জামের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের প্রতিবন্ধিতা কাটানোর চেষ্টা চলছে। অনেক প্রতিবন্ধী ফিজিওথেরাপির সেবাও পাচ্ছেন।

এইচআরডব্লিউ তথ্যচিত্র বলেছে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ শিবিরের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের বিরোধিতা করছে। ফলে প্রতিবন্ধীদের জন্য সদা গুরুত্বপূর্ণ পর্যাপ্ত আলো, গমনযোগ্য পায়খানা ও হাতলবিশিষ্ট চলার পথের উন্নয়ন কার্যক্রম ধীর গতিতে এগোচ্ছে।

“শরণার্থীদের সার্বিক দুর্দশা ও দুর্ভোগের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে,” বলেন ফ্রিলিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএসও) মতে দুনিয়ার এক বিলিয়নের বেশি মানুষ, অর্থাৎ প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। আর প্রতি দুজন প্রতিবন্ধীর মধ্যে একজন নিজের স্বাস্থ্যসেবার খরচ সংকুলান করতে পারে না।

নারী প্রতিবন্ধীদের দুর্ভোগ বেশি

টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা শারীরিক প্রতিবন্ধী খায়রুন্নেছা (৪৫) বেনারকে জানান, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামভিত্তিক এনজিও হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল তাঁদের ক্যাম্পের প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করছে।

“চশমা, ক্রাচ, হুইল চেয়ার দেয় তারা। আমাদের বিভিন্ন ট্রেনিংও করায়। তবে আমরা কোনো আর্থিক সহায়তা পাই না,” বলেন তিনি।

এই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ রফিক (৪৮) ও আনছার উল্লাহ (৩৩) মনে করেন, যেসব পরিবারে প্রতিবন্ধী রয়েছে, তাঁদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে তারা কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে না। মহিলা প্রতিবন্ধীরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মাত্র ১০ শতাংশ এলাকায় মহিলা ও পুরুষের জন্য আলাদা পায়খানা রয়েছে।

আইএমও’র দাবি রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় যে ৩১ শতাংশ পরিবারের নিরাপত্তা সুরক্ষা হুমকির মুখে রয়েছে, তার চার শতাংশ ঝুঁকিগ্রস্থ প্রতিবন্ধী সদস্যের কারণে। উল্লেখিত তথ্যচিত্রে বিল ফ্রিলিক বলেন, “শিবিরের (মেগা-ক্যাম্প) মধ্যে হাঁটার সময় আমরা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী পেয়েছি, যারা প্রতিবন্ধী।”

“এদের অনেকেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসেবে, রোহিঙ্গা শিবিরের ৬৬ শতাংশ স্থানে শুধু পায়ে হেঁটেই যাওয়া সম্ভব। ছবিটি কুতুপালং-বালুখালী মেগাক্যাম্পের তেমনই একটি পাহাড়ের। ৩১ আগস্ট ২০১৮।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসেবে, রোহিঙ্গা শিবিরের ৬৬ শতাংশ স্থানে শুধু পায়ে হেঁটেই যাওয়া সম্ভব। ছবিটি কুতুপালং-বালুখালী মেগাক্যাম্পের তেমনই একটি পাহাড়ের। ৩১ আগস্ট ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

 

৬৬ শতাংশই পায়ে হাঁটা পথ

এইচআরডব্লিউ’র দাবি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় জাতিসংঘ, বিভিন্ন মানবিক সংস্থা এবং শরণার্থীদের নিজেদের তৈরি করা অধিকাংশ পথ প্রতিবন্ধীদের চলাচল অনুপযোগী।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ ক্যাম্পের এক হাজার ৬০১টিসহ মোট এক হাজার ৯২৭টি স্থানে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। যার মধ্যে ৬৬ শতাংশ স্থানে শুধুমাত্র পায়ে হেঁটেই যাওয়া সম্ভব।

এ ছাড়া অটোরিকশা ঢুকতে পারে আট শতাংশ এলাকায়, শুধু মোটরসাইকেল যেতে পারে আরও ছয় শতাংশ এলাকায়। বড় ট্রাক ও ফোর হুইলার গাড়ি যেতে পারে যথাক্রমে নয় ও ১১ শতাংশ এলাকায়।

আরআরআরসি কালাম বেনারকে জানান, অবস্থান ও প্রতিবন্ধিতার ধরন বিচার করে রোহিঙ্গাদের এমন সব সরঞ্জামই দেওয়া হচ্ছে, যেগুলো ব্যবহার করে তারা চলাচল করতে পারবে।

ইউএনএইচসিআর এর বাংলাদেশ অফিসের মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, “সুরক্ষা কার্যক্রমে আমরা সবচেয়ে বেশি অসহায় এবং দুস্থদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখার চেষ্টা করি। এ দলে প্রতিবন্ধীরাও আছে।”

“যে সব পরিবারে বৃদ্ধ বা প্রতিবন্ধী আছে তাঁরা যদি সাহায্য কেন্দ্রে গিয়ে ত্রাণ নিতে না পারে তাহলে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয়। কোনো প্রতিবন্ধী যদি অসুস্থ থাকে তাহলে তাকে হেলথ সেন্টারে যেতেও সাহায্য করা হয়,” যোগ করেন তিনি।

জোসেফ আরও বলেন, “অন্যান্য শরণার্থীরা যেসব সুবিধা পায়, তারাও তাই পায়। তবে তাঁদের দিকে একটু বাড়তি খেয়াল রাখা হয়।”

টেকনাফ থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।