রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি দেখতে রাখাইন যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
2018.08.08
ঢাকা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের নেওয়া প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো সরেজমিনে দেখতে রাখাইন রাজ্য সফরে যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
এ উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গঠিত যৌথ কারিগরি কমিটির (জেডব্লিউজি) সদস্যদের নিয়ে বুধবার রাতেই ঢাকা ছেড়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সফরের শুরুতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইন পরিদর্শন করবেন। এর পর তিনি নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অগ্রগতির বিষয় নিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর অং সান সুচি এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।
কূটনৈতিক সূত্রমতে, গত ২৯ জুন বেইজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াই ইর মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের মন্ত্রী খ থিন শোয়ে-র সঙ্গে মাহমুদ আলীর ‘অনানুষ্ঠানিক’ বৈঠকে রাখাইন সফরের বিষয়টি নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফর নিয়ে বেশ আশাবাদী বলে জানান বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।
তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে সেদেশ থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সব পরিস্থিতি তুলে ধরা হবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সম্ভাবনাও রয়েছে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এবারের মিয়ানমার সফর, বিশেষ করে রাখাইন সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরাও।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “এটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রুটিন সফর হলেও দুটি বিষয় এখানে উঠে আসতে পারে। এক, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি কী সেটা জানা; দুই, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা বিনিময়।”
তাঁর মতে, “এ সফরের মাধ্যমে একটা অ্যাসেসমেন্ট পাবে বাংলাদেশ। কারণ, মিয়ানমার কখনোই প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। আর বাংলাদেশ তাকে বাধ্যও করতে পারবে না।”
“মিয়ানমারের মনোভাবটা এখন কী তা জানা যাবে। বাংলাদেশ হয়ত পরবর্তীতে এ নিয়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে মিয়ানমারের মনোভাবটা তুলে ধরতে পারবে,” মনে করেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইন সফর করবেন শুনে কিছুটা আশায় বুক বেঁধেছেন কক্সবাজারের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান আবদুল মতলব বেনারকে বলেন, “শুনেছি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইন সফর করবেন। তিনি নিশ্চয়ই সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতি দেখে আসবেন।”
“রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে মিয়ানমার সরকার ও মগরা মিলে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালায়। প্রাণে বাঁচতে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখো রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরতে চায়। তবে তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি, গণহত্যার বিচার, সহায়-সম্পত্তি ফেরত, নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন তিনি।
এর আগে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পরে আসা ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যোগ্য বিবেচনা করবে মিয়ানমার।
এই চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দফায় দফায় মিয়ানমারের শর্তের বেড়াজালে চুক্তির নয় মাস পরও বাংলাদেশে নিবন্ধিত একজন রোহিঙ্গারও প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি।
‘রোহিঙ্গা সমস্যা কমনওয়েলথ-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ’
এদিকে ঢাকা সফররত কমনওয়েলথ এর মহাসচিব প্যাট্রেশিয়া স্কটল্যান্ড বুধবার ঢাকায় এক সেমিনারে যোগ দিয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা কমনওয়েলথ এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সাথে কী হয়েছে সে সম্পর্কে সারা বিশ্ব অবগত ও শঙ্কিত। রোহিঙ্গাদের যেভাবে মানবাধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
মানবাধিকার রক্ষায় কমনওয়েলথ সনদ ও মূল্যবোধের বাস্তবায়ন, বিনিময় ও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে জবাবদিহি ও পারস্পরিক সহযোগিতা রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো মানবাধিকার সংক্রান্ত সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাবে বলে মনে করেন সংস্থাটির মহাসচিব।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসাও করেন প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আহ্বান
রয়টার্স জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফিরে আসতে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি উন্নতি করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থাগুলো। একই সঙ্গে যোগ্য ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে তারা।
বুধবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এবং ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের রাখাইন রাজ্যে পূর্ণ প্রবেশাধিকার প্রয়োজন এবং গত ১৪ জুন অনুরোধের পর থেকে মংডু শহরে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারা এখনো দেশটির অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছেন।
তারা জানায়, রাখাইনের মূল এলাকায় যে উল্লেখযোগ্য তিনটি অগ্রগতি অবিলম্বে প্রয়োজন তা হলো, রাখাইন রাজ্যে কার্যকর প্রবেশাধিকার প্রদান, সকল সম্প্রদায়ের জন্য চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সংকটের মূল কারণগুলোর সমাধান করা।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।