ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর জাতিসংঘের সমর্থন, দ্বীপে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালুর সুপারিশ

জেসমিন পাপড়ি
2021.06.02
ঢাকা
ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর জাতিসংঘের সমর্থন, দ্বীপে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালুর সুপারিশ ঢাকায় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজাও (বামে) ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের (ডানে) উপস্থিতিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন ইউএনএইচসিআর’র সুরক্ষাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার গিলিয়ান ট্রিগস (মাঝখানে)। ২ জুন ২০২১।
[জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের ভাসানচর স্থানান্তরের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বুধবার বলেছেন, বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করতে হবে। 

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত সোমবার ভাসানচর সফরকালে রেশন, কর্মসংস্থান, আর্থিক সুবিধাসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েকশ রোহিঙ্গা প্রতিবাদ করার পর তাঁরা এই মন্তব্য করলেন।

ভাসানচর পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের শিবিরগুলোর তুলনায় রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ভাসানচর অনেক ভালো।

পাশাপাশি, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে তাঁরা বলেছেন, এই দ্বীপে মর্যাদার সাথে রোহিঙ্গাদের বসবাস নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশকে সহায়তা করা। 

বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজাও এবং সুরক্ষাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার গিলিয়ান ট্রিগস। 

দুই কর্মকর্তার চারদিনের বাংলাদেশে সফর শেষে বুধবার রাতে ইউএনএইচসিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানায়। এতে বলা হয় বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকট অবশ্যই ভুলে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। 

‘কক্সবাজার থেকে ভাসানচর ভালো’

ভাসানচরে অবকাঠামোর প্রশংসা করে ব্রিফিংয়ে রাউফ মাজাও বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করেছে। জীবনযাত্রার বিষয়ে কক্সবাজারের সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, ভাসানচরের অবস্থা অনেক ভালো।”

“বিশেষ করে সরকার তৈরি তৈরি ঘরগুলো বেশি ভালো। ভাসানচরে রোহিঙ্গারা যাতে সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারেন, সেজন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে,” বলেন তিনি।

গত রোববার চার দিনের সফরে বাংলাদেশ আসার পর সোমবার তাঁরা ভাসানচর ও মঙ্গলবার কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। তাঁদের ভাসানচর পরিদর্শনকালে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে বিক্ষোভ করেন রোহিঙ্গারা। বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশসহ কয়েকজন শরণার্থী আহত হন।

ওই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন জাতিসংঘের এই দুই কর্মকর্তা। তবে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তাঁরা। বরং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। 

ভাসানচর পরিদর্শনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রাউফ মাজাও সাংবাদিকদের বলেন, “একটি বিষয় কিন্তু স্পষ্ট যে, এ ধরনের দ্বীপে (ভাসানচর) বসবাস করলে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে।”

“তাই সেখানে অবশ্যই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্যই সেখানে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আশা থাকবে, এ ব্যবস্থা সাময়িক। পাশাপাশি এ প্রত্যাশাও থাকবে, তারা দ্রুত (মিয়ানমার) ফিরে যাবে,” বলেন তিনি। 

দেরিতে হলেও জাতিসংঘের ভাসানচরকে মূল্যায়ন করে সেখানে সম্পৃক্ত হতে চাওয়াকে “অত্যন্ত ইতিবাচক” বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।

সরকার থেকে বারবার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হলেও এতদিন জাতিসংঘ গুরুত্ব না দেবার কারণ “কূটনৈতিক বোঝাপড়া এবং তথ্যের ঘাটতি” বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“এখন সরাসরি পরিদর্শন করে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন,” জানিয়ে ড. দেলোয়ার আশা করেন এবার “রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে দাতারা ভাসানচরে অর্থায়নে এগিয়ে আসবে।”

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছেন। 

কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে অধিকতর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয় করে নৌ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভাসানচর দ্বীপকে প্রস্তুত করে সরকার।

শুরু থেকেই ভাসানচরে বাসযোগ্যতার ওপর পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা বিষয়ক টেকনিক্যাল প্রোটেকশন অ্যাসেসমেন্ট করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল জাতিসংঘ। 

তবে সমীক্ষা ছাড়াই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তির মুখে গত ৪ ডিসেম্বর থেকে কয়েক ধাপে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে দ্বীপটিতে স্থানান্তর করে সরকার।

এদিকে ভাসানচরে সুযোগ সুবিধা কম হওয়ার অভিযোগ করে কিছু রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে দ্বীপটি থেকে পালিয়ে গেছেন। সর্বশেষ সোমবার তাঁরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সামনে। 

Coxs UNHCR PIC-1.jpg
কক্সবাজারের উখিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজাও (ডানে) ও সুরক্ষাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার গিলিয়ান ট্রিগসকে ব্রিফ করছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত। ১ জুন ২০২১। [সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

ভাসানচরে অর্থায়ন করবে জাতিসংঘ

রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ঘোষিত চলতি বছরের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে (জিআরপি) ভাসানচরের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেনি জাতিসংঘ।

এমন প্রেক্ষাপটে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থায়ন করবে কিনা জানতে চাইলে রাউফ মাজাও বলেন, “আমরা সরকারের সঙ্গে আছি এবং সরকারের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখব। বর্তমানে আমরা কক্সবাজারে কাজ করছি এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শরণার্থীদের কাজে সহায়তা অব্যাহত রাখব।” 

তবে কবে থেকে তারা ভাসানচরে সম্পৃক্ত হবেন, সে বিষয়টি পরিষ্কার করেননি জাতিসংঘের ওই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “ভাসানচরে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার লোক আছে, যারা বাংলাদেশে থাকা শরণার্থী। তাদের সহযোগিতা ও সহায়তা দেওয়া দরকার। তবে আমি কোনো সময়সীমা বলতে পারছি না।”

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকার ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাউফ মাজাও বলেন, “ভাসানচরে খালি জমি আছে, মাছ ধরার সুযোগ আছে। তারা (রোহিঙ্গারা) যেন বসে না থাকে। অলস বসে থাকলে মেধার অপচয় হয়।” 

“এটা (ভাসানচর) একটা সুযোগ। একে কাজে লাগাতে হবে। তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, বলপূর্বক যাদের বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, তাঁদের ফেরত (মিয়ানমারে) পাঠানো,” বলেন ইউএনএইচসিআরের কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার। 

তৃতীয় দেশে স্থানান্তর স্থায়ী সমাধান নয়

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে রোহিঙ্গারা তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।

এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সুরক্ষাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার গিলিয়ান ট্রিগস সাংবাদিকদের বলেন, “এটা করা সম্ভব, খুব ঝুঁকিতে যারা আছে এবং ছোট ছোট গ্রুপ নিয়ে এটা করে দেখা যেতে পারে। তবে এটা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়।” 

“সমাধান হলো তাঁদের আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে দেশে ফেরানো এবং আমরা এক সময় এটা করতে পারব,” বলেন তিনি। 

ট্রিগস বলেন, “আমরা ভাসানচর ও কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও স্বভূমে ফেরার স্বপ্নের কথা জানিয়েছে। তবে ফেরানোর প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা কঠিন, আপনারা তা জানেন এবং মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকদের নিতে চায় না।” 

প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘ কতটা যুক্ত আছে—জানতে চাইলে গিলিয়ান ট্রিগস জানান, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজটা একেবারেই কঠিন। তবে প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য মিয়ানমারকে রাজি করাতে জাতিসংঘ কাজ করে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে জাতিসংঘের আলোচনা করা উচিত বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন।

তিনি বলেন, “মিলিটারি সরকার কথা শুনবে। তাই তাদের ওপর তাঁরা (জাতিসংঘের কর্মকর্তা) অধিকতর চাপ দিলে ওরা কথা শুনবে। এতে রোহিঙ্গাদের যাওয়ার একটা পথ হবে।”

 ভাসানচরে বিক্ষোভ পরবর্তী অবস্থা

সোমবার জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে বিক্ষোভের ঘটনায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহে আলম।

তিনি বলেন, “সেসময় যারা বিশৃঙ্খলা করেছে, তাদের বিষয়ে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। কেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে, এর পেছনে কারা কোন ইন্ধন আছে সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” 

বিষয়টি নিয়ে দ্বীপের রোহিঙ্গারা ভয়ভীতির মধ্যে আছেন জানিয়ে ভাসানচরের এক রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ সোহেল বেনারকে বলেন, “জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে রোহিঙ্গাদের একটি দুষ্ট চক্র নেতৃত্ব দিয়েছে।”

“পুলিশ তদন্ত করছে। বিষয়টি নিয়ে নেতারাসহ সাধারণ রোহিঙ্গারাও ভীতির মধ্যে আছে,” বলেন তিনি। 

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।