ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর বিষয়ে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে জাতিসংঘ
2019.03.25
ঢাকা

কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকার নেয়া পরিকল্পনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা চেয়েছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে সম্মত হলে জাতিসংঘ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কীভাবে সেখানে যাবেন সে বিষয়েও জানতে চায় সংস্থাটি।
সোমবার জাতিসংঘের ঢাকা অফিস থেকে জ্যেষ্ঠ গণযোগাযোগ উপদেষ্টা আরি গাইতানিস স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব জানানো হয়।
এদিকে জাতিসংঘ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতামত পাওয়ার পরই স্থানান্তর কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।
গত ২১ মার্চ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর সহকারী হাইকমিশনার ভল্ক টুর্ক বলেন, তাঁর সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়।
তাঁর আগে কোনো জাতিসংঘ কর্মকর্তা ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাননি। জানুয়ারিতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি ভাসানচর সফর করেছেন। কিন্তু তিনি সম্প্রতি জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়া হলে ‘নতুন সঙ্কট’ সৃষ্টি হবে।
আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী জাতিসংঘ
কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের বিকল্প স্থানে সরিয়ে নেয়ার যে পরিকল্পনা সরকার করেছে জাতিসংঘ সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, “ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং টেকসই বসবাস নিশ্চিত করতে সেখানে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিল বিষয়সমূহ নিয়ে আমরা সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।”
জাতিসংঘ জানায়, “শরণার্থীরা ভাসানচরে যেতে রাজী হলে, তাঁদেরকে কীভাবে স্থানান্তর করা হবে, স্থানটি বসবাস উপযোগী কি না, সেখানে তাঁদের মৌলিক অধিকার থাকবে কি না, এবং তাঁদের জন্য কী কী সেবা নিশ্চিত করা হবে—সেগুলো নিয়ে আমরা সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি।”
তাছাড়া ওই স্থানের প্রশাসন কী হবে এবং জাতিসংঘ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কীভাবে সেখানে যাবেন সে বিষয়েও সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
ভাসানচরে স্থানান্তরের সম্ভাব্যতা এবং ওই দ্বীপে মানবিক সহয়তা কার্যক্রম শুরুর আগে কারিগরি বিষয়গুলোর পর্যালোচনাসহ বিস্তারিত মূল্যায়ন প্রয়োজন আছে বলে মনে করে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ মনে করে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর অবশ্যই নিজেদের ইচ্ছায় হতে হবে এবং এই প্রকল্প সংক্রান্ত সকল নির্ভুল তথ্য সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের দিতে হবে। আর এর মাধ্যমে তারা সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে জেনে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
কেন ভাসানচর বিতর্ক?
২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর আল-ইয়াকিন এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করার পর রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত উত্তর রাখাইন রাজ্যে দুটি পৃথক নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে সেদেশে সামরিক বাহিনী ও জঙ্গি বৌদ্ধরা।
প্রাণ ভয়ে দু’দফায় প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ১৫ দিনের ব্যবধানে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
তারা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় খুপরি ঘরে নোংরা পরিবেশে জীবনযাপন করছে।
উখিয়ার স্থানীয় জনসংখ্যা পাঁচ লাখ আর রোহিঙ্গার সংখ্যা আট লাখের বেশি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সহসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে না—এমন বিবেচনা মাথায় রেখে নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দ্বীপ ভাসানচরে বিকল্প আবাসন প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ সরকার।
এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ একলাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেয়া হবে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান আগে জানালেও সোমবার তিনি বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “আমরা একটু ধীরেসুস্থে আগাচ্ছি। এখনো স্থানান্তরের নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমরা কোনো তাড়াহুড়া করছি না। জাতিসংঘের সব সংস্থা এবং রোহিঙ্গাদের সাথে একমতে পৌঁছানোর পরই কেবল এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে।”
জাতিসংঘ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ধারণা, দ্বীপটি বর্ষায় পানিতে ডুবে যায়। এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মহসিন বেনারকে বলেন, “ভাসানচর দ্বীপটি উন্নয়ন করে খুব অসাধারণ একটি আবাসন প্রকল্পে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ‘দ্বীপটি বসবাসযোগ্য নয়’—এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।”
এদিকে ২৩ মার্চ রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহয়তার ব্যাপারে পরিকল্পনা করছে।
এ ব্যাপারে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার কাছে, ই-মেইলে মন্তব্য চাওয়া হলে তারা কোনো জবাব দেয়নি।
সরকারের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “প্রথম দিকে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। আলোচনার মাধ্যমে তারা এখন অনেকটাই স্থানান্তরের পক্ষে, যদিও কিছু বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে।”
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ভাসানচরে গিয়ে দ্বীপটি উদ্বোধন করার পর স্থানান্তর শুরু হবে। তবে জাতিসংঘের সাথে সরকারের সমঝোতার পর প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন।”
‘রোহিঙ্গাদের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো’
পাঁচদিনের আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব মিশন শেষ করেছেন কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পদস্থ কর্মকর্তারা।
সোমবার হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মানবিক বিষয় সমন্বয় সংক্রান্ত সংস্থার সহকারী মহাসচিব রশিদ এম. খালিকভ জানান, তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে বাংলাদেশে এসেছেন।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো।”
খালিকভ বলেন, তাঁর মিশন রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান দিতে দাতাদের প্রতি আহ্বান জানাবে।
ইউরোপীয় কমিশনের মানবিক ত্রাণ কার্যক্রমের পরিচালক অ্যানড্রুলা কামিনারা বলেন, “শরণার্থীরা আগের চেয়ে ভালো হলেও কিছু শঙ্কা রয়ে গেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না।”
তাঁর মতে, “রোহিঙ্গারা যদি এখনই চলে যেতে রাজি হয় তবুও সময় দরকার। সুতরাং, তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় একটি প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাবে।”