কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় তোলপাড়
2016.03.24

একটি নিষ্ঠুর ও নৃশংস খুনের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে, যার শিকার হয়েছে সোহাগী জাহান তনু (১৯) নামে এক কলেজ ছাত্রী। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ওই তরুণীকে।
গত রোববার কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে তনুর লাশ পাওয়ার পর পাঁচ দিন পার হলেও এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়নি দুষ্কৃতকারীদের কেউই। ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
কুমিল্লা, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারী সংগঠনগুলো প্রতিদিন বিক্ষোভ–সমাবেশ করছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার দাবি করেছে তনুর পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) সম্প্রতি হিসাব দিয়েছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সারা দেশে ৮৪৬ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই সময়ে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হয়েছে ৬০ জনের।
তনু হত্যাকাণ্ড
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইতিহাস বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু। তার বাবা কুমিল্লা সেনানিবাসে বোর্ডের একজন বেসামরিক কর্মচারী। বাবার সুবাদে সেনানিবাসে কোয়ার্টারে বসবাস তাদের।
বাড়ির সবার ছোট মেধাবী তনু লেখাপড়ার পাশাপাশি ভিক্টোরিয়া কলেজে নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবার অল্প আয়ের সংসারে নিজের খরচ নিজে কিছুটা চালাতে সেনানিবাসের ভেতরেই একটি বাসায় টিউশনি করতেন তিনি।
তনুর বড় ভাই নাজমুল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিদিনের মত গত রোববার (২০ মার্চ) বিকেলে টিউশনি করতে যায় তনু। রাত আটটা বেজে গেলেও বাড়ি না ফেরায় তাঁকে খুঁজতে রাস্তায় বের হন তাদের মা।
এদিকে তনু যে বাসায় পড়াতেন, সেই বাসায় খোঁজ নিলে তারা জানান, সন্ধ্যা সাতটার দিকেই তনু চলে গেছে। রাত ক্রমেই বাড়তে থাকে। রাত দশটায় বাসায় ফিরে তাদের বাবা আবারও খুঁজতে বের হন। আর তখনই সেনানিবাসের ভেতরে একটি কালভার্টের নিচে এই তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। এই পথ দিয়েই টিউশনি শেষে বাসায় ফিরতেন তনু।
তনুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ হত্যাকাণ্ডটি সেনানিবাস এলাকায় হওয়ায় তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কারণ, প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললেও এ হত্যার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার করে কিছুই বলছে না।
তবে এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, তনুকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েই হত্যা করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি নন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
চলছে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ
তনু হত্যার বিচারের দাবিতে মাঠে নেমেছে লাখো শিক্ষার্থী, হাজারো নাট্যকর্মীসহ সকল স্তরের মানুষ।
গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।
বুধবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমাবেশ করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ঘটনাটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সংঘটিত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই দায়ী করেছেন জোটের নেতারা।
সংস্কৃতিকর্মীদের এই সংগঠনের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি ও সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবনতি হচ্ছে একইভাবে পাল্লা দিয়ে সমাজের অবক্ষয় হচ্ছে।’
তিনি বলেন, সমাজে প্রতিনিয়ত তনু হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা দেখেও জোরালো প্রতিবাদ আসছে না। এ ধরনের ঘটনারে প্রতিবাদে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। অপরাধীর যোগ্য সাজা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সমাজের দৃশ্যপট বদলাবে।
এদিকে নারী অধিকার আন্দোলনকারীরা বলেছেন, তনু হত্যা নারীর প্রতি সহিংসতা অত্যন্ত চেনা একটি রূপ। প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও বিচারহীনতার কারণেই অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের পরিচালক নুর খান বেনারকে বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু বিচারের খবর মেলে না। ভুক্তভোগীরা বিচার হীনতায় ভোগে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি শুধু নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রেই নয়, বলা যায় সকল ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। এখান থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত সমাজে অনাচার, অবিচার থেকে নারী শিশু আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা কেউই রেহাই পাবে না। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে আইন-শৃঙ্খলাসহ সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে হবে। তবেই নারীরা সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে।”
এক বছরে ধর্ষণে মৃত্যু ৬০ জনের
আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে সারা দেশে ৮৪৬ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৬৩ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর এবং ৫৩ জন ছয় বছরেরও কম বয়সী শিশু।
মানবাধিকার এই সংগঠনটির জরিপ বলছে, চলতি বছরের প্রথম মাসেও ৫৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে ধর্ষণের পর মৃত্যু হয় একজনের। এ ছাড়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে আরও দুজন নারী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্যাতিত নারী ও তাদের লাশের মিছিল প্রতিনিয়ত লম্বা হচ্ছে। একমাত্র সুশাসনের মাধ্যমেই এর প্রতিরোধ সম্ভব।