১২ শিক্ষার্থীকে পাঁচ দিন আটকে রেখে আদালতে উপস্থাপনের অভিযোগ
2018.09.10
ঢাকা

মোসাম্মৎ নাজমা বেগম গার্মেন্টসকর্মী। ছেলে আল আমিনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে এই খবর পেয়ে চারটি দিন ডিবির ফটকে অপেক্ষায় কেটেছে তাঁর। অবশেষে সোমবার ছেলেকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
নাজমা বেগম একা নন, তাঁর ছেলেসহ মোট ৩৮জনকে গত ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার তেজকুনিপাড়ার একটি ছাত্রাবাস থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় একদল লোক। একদিন পর ২৬ জনকে মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ কার্যালয় থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ১২ জনের ব্যাপারে মুখ খুলছিল না তারা।
রবিবার সন্তানদের সন্ধান চেয়ে পরিবারগুলো সংবাদ সম্মেলন করে। এর ২৪ ঘণ্টা পর পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায়, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সরকার বিরোধী আন্দোলন, জনসাধারণের চলাচলে বাধা, সরকারি কর্মচারীদের কাজে বাধা ও হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ সাত দিনের রিমান্ড চাইলে, আদালত দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের আদালতে হাজির করার বিধান থাকলেও তা মানা হলো না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বলেন, পুলিশ আইন অমান্য করেনি।
“পরিবার যাই বলুক, তারা গতরাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। অপরাধ যারা করে তারা পরিবারকে জানায় না। তারা গা ঢাকা দিয়েছিল। ডিবি অভিযান চালিয়ে রোববার রাতে তেজকুনি পাড়া থেকে ১২ জনকে ধরেছে।,” মাসুদুর রহমান এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায় ১২ জনের এই দলটির প্রধান তারেক আজিজ। তারা সবাই শিবিরের নেতা–কর্মী।
গ্রেপ্তারকৃতদের অপরাধ
গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীরা হলেন তারেক আজিজ, মো. তারেক, জাহাঙ্গীর আলম, মো. মোজাহিদুল ইসলাম, মো. আল আমীন, মো. জহিরুল ইসলাম, মো. বোরহান উদ্দিন, ইফতেখার আলম, মো. মেহেদী হাসান রাজিব, মো. মাহফুজ, মো. সাইফুল্লাহ ও মো. রায়হানুল আবেদিন।
গোয়েন্দা বিভাগ (উত্তর) উপকমিশনার মশিউর রহমান বেনারকে বলেন, ১২ জনের সবাই অপরাধী।
“নিরাপদ সড়কের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়েছিল। এই ১২ জনের কেউ স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী ছিল না। তাদের কাছ থেকে স্কুল ড্রেস ও ভুয়া আইডি কার্ড পাওয়া গেছে। তা ছাড়া তারা সবাই শিবিরকর্মী,” মশিউর রহমান বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে যেসব ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে সেগুলোও দেখানো হয়। পোস্টগুলোর মধ্যে ‘জিগাতলায় কি হয়েছে স্টুডেন্টের মুখ থেকে শুনুন’, ‘৪ জন মারা গেছে’, ‘৪ জন ধর্ষণ’, ‘শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ির লাইসেন্স নাই’, ‘গাড়ি ভেতর মুড়ি’, ‘পুলিশ ঘুষ খায়’, ‘মন্ত্রী এমপি সবাই চোর’ ইত্যাদি ছিল। একটি ফুটেজে একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িতে কার্টুন আঁকতেও দেখা যায়।
পুলিশ দাবি করেছে, গত ৬ আগস্ট এই শিক্ষার্থীরা এবং আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত ছাত্ররা একত্রিত হয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ জন মিলে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সরকার বিরোধী বিভিন্ন উত্তেজনাকর স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা রাস্তা বন্ধ করে দেয়। উচ্ছৃঙ্খল ছাত্ররা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে পুলিশ সদস্যরা আহত হন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কথা
মানসুর রহমান বেনারকে বলেন, তাঁর দুই ছেলে সিফাত ও সাইফুল্লাহ দুজনকেই ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে যায় গত ৫ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা। একদিন পর সিফাতকে ছেড়ে দিলেও সাইফুল্লাহর ব্যাপারে পুলিশ কিছু বলছিল না। সাইফুল্লাহ করটিয়া সাদত কলেজের শিক্ষার্থী। একটা প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ছোট ভাইয়ের কাছে এসে উঠেছিলেন। গতকাল সাইফুল্লাহকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তারপরও মানসুর রহমান খুশি।
“তবুও আমি খুশি। ছেলে বেঁচে আছে এই খবরটুকু তো পেলাম,” মানসুর রহমান বলেন।
তেজকুনি পাড়ার যে ছাত্রবাস থেকে ১২জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে সেই ছাত্রাবাসটি একটি পাঁচতলা ভবনের দুটি তলায়। ভবনটির নাম ইউসুফ কুঠি। ইউসুফ কুঠির একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, মহাখালী থেকে হাতকড়া পরা অবস্থায় একজন ছেলেকে নিয়ে ডিবি ইউসুফ কুঠি থেকে শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে যায়। পরে কেউ কেউ ছাড়াও পায়।
ছাড়া পাওয়া এক শিক্ষার্থীর বড় ভাই শামীম ভূইয়া। তিনি বেনারকে বলেন, তাঁর ভাই মাস দুয়েক আগে ওই ছাত্রাবাসে ওঠে। তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে জেনে তিনি নরসিংদী থেকে ঢাকায় আসেন। পরে মুচলেকা দিয়ে ভাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
“মুচলেকায় সরকার বিরোধী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আমার ভাইকে আটক করা হয়েছিল বলে লেখা আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছে সে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত ছিল কি না,” শামীম বলেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উদ্বেগ
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে ডিবি কার্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার নিন্দা জানিয়েছে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় সহপাঠীদের মৃত্যুর ঘটনায় ন্যায়বিচার ও সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন আচরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
আসক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানাচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আটক করার পরও আদালতে হাজির না করার মতো উত্থাপিত অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর, বেআইনি এবং স্পষ্টত মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।