কোটা সংস্কার: নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ সভায় পুলিশের বাধা

প্রাপ্তি রহমান
2018.07.03
ঢাকা
180703_Quota_1000.jpg ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হককে তুলে নিয়ে যাবার জন্য পুলিশের ধস্তাধস্তি। ৩ জুলাই ২০১৮।
বেনারনিউজ

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের কর্মসূচি ছিল মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। আয়োজকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই সেখানে উপস্থিত হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। তারপর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় প্রতিবাদকারী শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে।

কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে এর আগ পর্যন্ত পুলিশের খুব একটা সক্রিয়তা চোখে পড়েনি। তবে গতকাল পুলিশ উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে। একদিনে তারা সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের তিন ছাত্রকে কারাগারে পাঠিয়েছে।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের কর্মসূচি থেকে পুলিশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকি বিল্লাহকে আটক করে প্রিজনভ্যানে ওঠায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ প্রিজনভ্যানে ওঠেন। ৪০ মিনিট পর পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দেয়। ফিরে এসে তাঁরা আবার প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন।

পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাহমিদুল হক লেখেন, “আমার পরিচয় দেওয়ার পরও পুলিশ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। ...অফিসার এসে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে আমি প্রিজন ভ্যানের ক্ষতিসাধন করেছি। তাই গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশের সঙ্গে আমার ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়েছে, তারা গ্রেপ্তারও করতে চেয়েছে, কিন্তু আন্দোলনকারীরা করতে দেয়নি।”

প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ।

“শান্তিপূর্ণ সমাবেশও সরকার সহ্য করতে পারছে না, এটা সরকারের অক্ষমতা,” আনু মুহাম্মদ বলেন। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে যা বলেছিলেন তা ছিল তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ।

পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সর্দার বলেন, নাশকতার আশঙ্কায় পুলিশ এই কর্মসূচি বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু পরে যখন দেখা যায় সেখানে বিশিষ্ট কিছু নাগরিকও রয়েছেন তখন তাঁদের কর্মসূচিতে আর বাধা দেওয়া হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দখলে, গ্রেপ্তার আট

গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের দখলে। কোটা সংস্কারের দাবিতে গঠিত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা গতকালও ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেননি।

বিকেলের দিকে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার দেখায়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারুক হোসেন ও জসিমউদ্দীন, অন্যজনের নাম তরিকুল ইসলাম।

এর আগে গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখন পুলিশ হেফাজতে আছেন। অন্য তিনজনকে আদালতে উপস্থাপনের পর বিচারক কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান গতকাল চার মামলায় আটজনের গ্রেপ্তারের খবর নিশ্চিত করেছেন।

“কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মোট চারটি মামলা হয়েছে। গতকাল তিনজনের বিরুদ্ধে পুলিশের বিশেষ শাখা এসবির এক সদস্যর মোটরসাইকেল ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে,” মাসুদুর রহমান বলেন।

অভিযোগ আছে, সোমবার ফারুক হাসানকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মারধর করার পর ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে। আর জসিম উদ্দিনকে পাবলিক লাইব্রেরির ভেতর থেকে তুলে নেওয়া হয়। তা ছাড়া মাহফুজ নামের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ককে গ্রেপ্তারকৃত রাশেদের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। গতকাল রাত পর্যন্ত মাহফুজের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

ফারুক হোসেনের বড় ভাই মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, তিনি দিনভর খোঁজাখুঁজির পর বিকেলে জানতে পারেন ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

“সোমবার থেকে আমার ভাইয়ের ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম। সকালে শাহবাগ থানা, নিউ মার্কেট থানা ও রমনা থানায় গিয়েও ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাইনি। বিকেলে জানতে পারি মামলা হয়েছে। তাকে কেরানীঞ্জ কারাগারে নেওয়া হয়েছে,” আরিফুল ইসলাম বেনারনিউজকে বলেন।

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলছিলেন, তিনি আতঙ্কে আছেন।

“যেকোনো সময় আমি গ্রেপ্তার হতে পারি। আমাদের সবাই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা নিজেদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছি না,” হাসান আল মামুন বেনার নিউজকে বলছিলেন।

আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীরা সরকারি ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মী হওয়ায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে একজন সাংবাদিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, আন্দোলনকারীদের ওপর যারা হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কিনা?

জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পুলিশ কখনো যায় না, যতক্ষণ না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকে। ছাত্ররা-ছাত্ররা কী করেছে, সেটা আমাদের জানা নেই। কোনো ছাত্র যদি অভিযোগ করে, তাহলে তখন আমরা দেখব।”

কোটা নিয়ে আন্দোলন করার কোনও প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, কোটা নিয়ে আন্দলনের কোনও প্রয়োজন নেই।

নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ ও ছাত্রলীগের কর্মসূচি

কোটা সংস্কারপন্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল কর্মসূচি পালন করেছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ ছাত্রদের মোর্চা নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ। তাঁদের হাতে ছিল বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। এর একটিতে লেখা ছিল ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাস থেকে শিক্ষা বাঁচাও’। তাঁরা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য দাবি করেন।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একেএম গোলাম রব্বানী তাঁদের এড়িয়ে যান।

ওই একই সময় টিএসসিতে মানববন্ধন করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ‘গুজবকে না বলুন’, ‘আবেগ সরিয়ে বিবেক আনুন’ ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তানভীরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “আমি প্রথমে ছাত্র, তারপর ছাত্রলীগ। আমরা সবাই মিলে ক্যাম্পাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি।”

ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, তিনি পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত নন।

“কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় ছাত্রের পাশে থাকে। এটাই তার ঐতিহ্য। কেউ অভিযোগ দিলে আমি অবশ্যই খতিয়ে দেখব,” একেএম গোলাম রব্বানী বেনারকে বলেন।

তিনি আরও বলেন, কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন বিষয় নিয়ে পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে সেটাও দেখতে হবে।

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কেউ কোনো মামলা বা অভিযোগ জানায়নি।

কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সংগঠিতভাবে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। অব্যাহত আন্দোলনের মুখে গত ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন।

প্রায় তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় ঈদের পর ছাত্ররা আবারও আন্দোলন শুরু করে। সোমবার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোটা সংস্কারে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।