সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রম, দুই সদস্যসহ হুজির প্রধান সমন্বয়ক গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.03.05
ঢাকা
সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রম, দুই সদস্যসহ হুজির প্রধান সমন্বয়ক গ্রেপ্তার ঢাকার খিলগাঁওয়ে তল্লাশি চৌকিতে বিস্ফোরণ চেষ্টার সময় পুলিশের গুলিতে এক সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হবার পর আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছেন র‍্যাব সদস্যরা। ১৮ মার্চ ২০১৭।
[রয়টার্স]

আল-কায়েদার আদর্শে বিশ্বাসী দেশের প্রথম জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী-বাংলাদেশের (হুজি-বি) অপারেশন শাখার প্রধানসহ সংগঠনটির তিন জঙ্গিকে আটক করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, যারা ঢাকায় নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন।

এদের মধ্যে হুজি-বি অপারেশন শাখার প্রধান মাইনুল ইসলাম সাংবাদিক পরিচয়ে ঘুরে বেড়াতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার হুজি-বি এর অপারেশন শাখার প্রধান মো. মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসান, শেখ সোহান সাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবিরকে আটক করা হয়।

বলা হয়, আটকের সময় তাঁদের কাছ থেকে একটি প্রাইভেট কার, চাপাতি, ডেটোনেটর, লোহার বিয়ারিং, লিটার এসিডসহ বোমা তৈরির বিভিন্ন সামগ্রীসহ উগ্রবাদী আদর্শের বই উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “মাইনুল ইসলাম ওই প্রাইভেট কারে সাংবাদিক স্টিকার লাগিয়ে সাংবাদিকের পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াত।” 

তিনি বলেন, জঙ্গিরা মাইনুল ইসলামের নেতৃত্বে হুজিকে পুনর্গঠন করতে পূর্ণাঙ্গ শুরা কমিটি প্রস্তুত করতে কাজ করছিল। সংগঠনকে পুনর্গঠিত করা ছাড়াও সংগঠনের জন্য সদস্য নিয়োগের মাধ্যমে অস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে কাজ করছিল।

সাইফুল ইসলাম বলেন, “মাইনুলসহ ধৃতরা বান্দরবান-নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় জমি লিজ নিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করার কাজে নিয়োজিত ছিল। তারা বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় তাদের সংগঠনের বিস্তার ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন পরিচয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল।”

জঙ্গিরা কারাগারে আটক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর ও ২০০০ সালের কোটালিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানের নির্দেশে সাংগঠনিক কাজ করছিল বলে জানান সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “মাইনুল ইসলাম ২০১৫ সালে হুজি’র শীর্ষ নেতা কারাবন্দি মুফতি মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়।”

জঙ্গি কার্যক্রমের দায়ে ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ হুজি-বি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন “আল-কায়েদার আদর্শে বিশ্বাসী” বলে জানান সাইফুল ইসলাম।

গ্রেপ্তারকৃত সোহান ঢাকায় মিরপুর বাংলা কলেজে পড়ার পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০১৬ সালে একুশে বই মেলায় নাশকতার ঘটনায়, ২০১৭ সালে বিষ্ফোরক মামলায় এবং ২০১৯ সালে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের একটি মামলায় সোহান গ্রেফতার হন বলেও জানানো হয় পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

মুরাদ ব্যবসার আড়ালে হুজির দাওয়াতি ও বায়তুল মালের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বলে জানানো হয়।

গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে। 

'আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড'

মাইনুলের গ্রেপ্তারকে “একটি বড়ো অর্জন” হিসেবে আখ্যায়িত করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “হুজি-বি বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গি সংগঠন। এরা আল-কায়েদার আদর্শে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে থেকে যারা আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তারা দেশে ফিরে আসার আগে প্রতিজ্ঞা করে বাংলাদেশে ‘তাগুতি শক্তিকে’ ধ্বংস করবে। এই লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে হুজি-বি আত্মপ্রকাশ করে। মাওলানা আব্দুস সালাম এর প্রতিষ্ঠাতা।”

“তাগুতি শক্তি বলতে তারা সাংস্কৃতিক শক্তিকে বুঝাত,” জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ মানুষ আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর দেশে ফিরে আসে। এরা দেশে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করে। আর মুফতি হান্নান সংগঠনের নেতৃত্বে আসার পর তাদের কর্মকাণ্ডে গতি পায়।”

দেশে নিষিদ্ধ হবার পর ২০০৯ সালে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতায় হুজি-বি’র সাংগঠনিক কার্যক্রম প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, ২০১৭ সালে মুফতি হান্নানের ফাঁসি হয় জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “এরপর থেকে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। এখন তারা আবার পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।” 

দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হুজি-বি’র আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “সে কারণে তারা সর্বপ্রথম যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায়। এরপর রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখে হামলা চালায়।”

তিনি জানান, হুজি-বি ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখে। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নেয়। একই বছর ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা চালায়।

“আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়ে। মুফতি হান্নানের ফাঁসি হয়েছে। তবে তারা ধ্বংস হয়নি। তারা আবার নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে,” বলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।

২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি। এই অপরাধে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল কাশিমপুর কারাগারে মুফতি আব্দুল হান্নানকে ফাঁসি দেয়া হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।