ঢাকা ও চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর দুই মামলায় ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড

প্রাপ্তি রহমান
2020.01.20
ঢাকা
200120-BD-sentence-620.jpg ২০০১ সালে পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় হরকাতুল জিহাদ এর এক অভিযুক্তকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পুলিশ। ২০ জানুয়ারি ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের আদালত পৃথক দুটি চাঞ্চল্যকর মামলায় পনেরো জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন পাঁচ পুলিশ সদস্য ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, বাংলাদেশের দশ জন।

চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সমাবেশে হামলা মামলার রায় হতে সময় লাগল ৩১ বছর, অন্যদিকে ঢাকায় কমিউনস্টি পার্টি অব বাংলাদেশের (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা মামলার রায় হলো ১৯ বছর পর।

দেরিতে হলেও রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ২৪ জন নিহত হন। মানববেষ্টনী তৈরি করে ওইদিন দলের নেতাকর্মীরা তাঁকে রক্ষা করেন।

সোমবার চট্টগ্রাম বিভাগীয় জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো ইসমাইল হোসেন পাঁচ পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, জে সি মন্ডল, প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজউদ্দীন, মোস্তাফিজুর রহমান ও শাহ আবদুল্লাহ। এদের মধ্যে জে সি মন্ডল পলাতক।

রায়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, “নব্বই এ এরশাদের পতনের পর যে দলই সরকার গঠন করুক, সেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে এমনটাই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে বিচার শুরু করেনি। মামলা তদন্তের অনুমতিও পাওয়া যায়নি বরং প্রধান অভিযুক্ত মির্জা রাকিবুল হুদা রাজউকের চেয়ারম্যান হন।”

তবে দেরিতে হলেও মামলার রায়ে সন্তুষ্ট লালদীঘি ময়দান হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী।

“অনেক সময় সাক্ষী আসেনি। রকিবুল হুদা মারা গেছেন কি না এ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতেও সময় পার করেছে আসামিপক্ষ। তবু বলব, দেরিতে হলেও এই রায় দৃষ্টান্তমূলক,” সাংবাদিকদের বলেন ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী।

বিচারে পদে পদে বাধা

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা নিজেই বিচারের ধীরগতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্য এরশাদের আমলে মামলা করতে না পারা, বিএনপি আমলে বিচার শুরু না করা, সাক্ষী হাজির করায় পুলিশের ব্যর্থতা, বিচারিক আদালতে বিচারক না থাকাকে দায়ী করেন।

লালদীঘির ময়দানে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলার বাদী শহীদুল হুদা ৪৬ জনকে আসামী করে মামলা করেন। তিনি মারা গেছেন। বেঁচে নেই মামলার এক নম্বর আসামী মির্জা রকিবুল হুদা। সবশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল কাদের এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও আতাউর রহমান খান কায়সারও মারা গেছেন।

তবে ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত স্বজনদের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকে। ২০১৬ সালের ২৬ মে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনুপম সেন আদালতে সাক্ষ্য দেন। আদালত সূত্রে পাওয়া যায় তাঁর সাক্ষ্য।

“বিভিন্নজনকে গুলি খেয়ে কাতরাতে দেখা যায়। ...গুলিতে নিহতদেও কারও লাশ পরিবারকে নিতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। হিন্দু, মুসলিম নির্বিচারে সবাইকে বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলে,” অনুপম সেন তাঁর সাক্ষ্যে বলেন।

গতকাল রায় ঘোষণার পর বেনারনিউজের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাদী শহীদুল হুদার ছেলে আইনজীবী এরশাদ হোসেন এর।

“ঘটনার পর বাবা যখন মামলা করতে গেলেন, কেউ সাহায্য করেনি। আসামিপক্ষের লোকজনের হুমকি-ধামকি তো ছিলই। তারপরও ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ বাবা মামলা করেন,” এরশাদ হোসেন বলেন।

আদালত সূত্রে জানা যায়, বিএনপি আমলে এই মামলা আর এগোয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে। তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।

দুই দফায় এই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় সংস্থাটি। প্রথমে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি ও পরে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর।

দুই বছরে আদালতে সাক্ষী দেন মাত্র দুজন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি শাসনামলে এবং ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও মামলা চলেনি।

২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিভাগীয় আদালতে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। তাও মামলার কার্যক্রম বাধার মুখে পড়ে আদালতে বিচারক না থাকা এবং এক নম্বর আসামি মির্জা রকিবুল হুদার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায়।

অবশেষে সোমবার এই জনাকীর্ণ আদালতে বিচারক চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় দিলেন।

হুজি-বি’র ১০ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড

ঢাকার অতিরিক্তি মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম ঢাকায় ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় ১০জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। খালাস দিয়েছেন দুজনকে। অন্য মামলায় হুজি-বি’র আমির মুফতি আবদুল হান্নানের মৃত্যুদণ্ড আগেই কার্যকর হওয়ায় তাঁকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টনের বোমা হামলায় ঘটনাস্থলে নিহত হন চারজন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২দিন পর মারা যান আরও একজন।

১০৪ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক বলেন হুজি-বি সিপিবিকে নিঃশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। কারণ তারা মনে করে সিপিবির কর্মী-সমর্থকেরা কাফের, বিধর্মী ও নাস্তিক।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দশ আসামির ছয়জনই পলাতক। পলাতক আসামিরা হলেন জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুক্তাকিন, আমিনুল মুরসালিন, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান ও নূর ইসলাম।

কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন মুফতি মঈনউদ্দীন শেখ, আরিফ হাসান সুমন, সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ।

রায় ঘোষণার সময় তাঁদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায়নি।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সালাহউদ্দীন হাওলাদার বলেন, রায়ে তাঁরা সন্তুষ্ট।

“এই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আমরা হিমাগার থেকে মামলা টেনে বের করেছি। ছয়বার শুধু তদন্ত কর্মকর্তাই বদলেছে,” সালাহউদ্দীন হাওলাদার বলেন।

অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, সাউন্ড সিস্টেম বিস্ফোরণ থেকে ঘটনার সূত্রপাত বলে তাঁরা আদালতকে জানিয়েছিলেন।

“আসামিদের একজন ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছে। সে দেশের সংবাদপত্রে ওই আসামিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেটি আমলে নিয়েই বিচারক রায় দিলেন,” ফারুক আহম্মেদ সাংবাদিকদের বলেন।

মামলার বাদী ছিলেন সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মনজুরুল আহসান খান। মতিঝিল থানায় বাদী হয়ে তিনিই মামলা করেছিলেন। ২০০৩ সালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোমিন হোসেন আদালতকে বলেন, তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

যদিও ২০০১ সালেই রমনার বটমূলে একই কায়দায় বোমা হামলা হয়।

এই মামলার সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির মৃণাল কান্তি সাহা। ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এ মামলায় সাক্ষী ছিলেন ১০৬জন, রাষ্ট্রপক্ষ ৩৮জনকে হাজির করে। আসামিপক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিল না।

গতবছর ১ ডিসেম্বর এ মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়।

সিপিবি যা বলছে

এক বিবৃতিতে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম অবিলম্বে বিচারের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন।

যৌথ ওই বিবৃতিতে তাঁরা আরও বলেন, “বোমা হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। সিপিবি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এসব পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে।”

সিপিবি মনে করে জঙ্গিদের কিলিং স্কোয়াডের পেছনে অন্যান্য শক্তির যোগসাজস ছিল। সেগুলোর উদ্ঘাটনে ট্রুথ কমিশন গঠন জরুরি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।