মজুরি ‘মাইর যায়’ নির্মাণ শ্রমিকদের
2019.05.01
ঢাকা

১৯৮৮ সাল। ২১৬ কিলোমিটার দূরের জেলা পাবনা থেকে ঢাকায় এসে ইমারত নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন ৩২ বছরের যুবক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি দেখলেন, একটি ভবনে দিনভর ৪০ থেকে ৬০ জন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছে, কিন্তু সন্ধ্যায় মালিক তাদের মজুরি না দিয়ে গালাগালি ও মারধর শুরু করেছে।
“তখন এটা দেখেই মনে হয়েছিল, কীভাবে আমরা একটা প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত হয়ে মালিকের হাতে মার খাওয়া বন্ধ এবং সময় মতো ন্যায্য মজুরি পাওয়ার অধিকারটুকু আদায় করতে পারি। এটাই ছিল আমাদের প্রথম লক্ষ্য,” মে দিবসের প্রাক্কালে বেনারকে বলছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। বর্তমানে যিনি ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) সাধারণ সম্পাদক।
কয়েক বছর চেষ্টার পর ১৯৯৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন হিসেবে নিবন্ধন পায় ইনসাব। যদিও ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধনের আগে পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবে আইনি স্বীকৃতি ছিল না নির্মাণ শ্রমিকদের।
এই স্বীকৃতি ২০০৩ সাল থেকে রাজপথে আন্দোলনের সুফল বলে দাবি করেন ইনসাব নেতারা। তবে আজও সঠিক সময়ে মজুরি পাওয়ার নিশ্চয়তা পায়নি বাংলাদেশের ৩৭ লাখ (২০১৬ সালের সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৩৫ লাখ) নির্মাণ শ্রমিক।
মজুরি ‘মাইর যায়'
বেনারের সরেজমিন অনুসন্ধানে বছরের পর বছর নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি আটকে রাখার নজিরও মিলেছে।
রাজধানীর মিরপুর এলাকার এক ভবন নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত রাজমিস্ত্রী মনির হোসেন (৩৪) বেনারকে বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠিকাদার শ্রমিকদের টাকা ‘মাইরা দিয়া’ চলে যায়।”
“যাদের শ্রমিক সংগঠনে নাম আছে, বা শক্তিশালী আত্মীয়-স্বজন আছে – তারা চাপ দিয়ে টাকা উঠিয়ে নিতে পারে, কিন্তু অন্যরা পারে না,” বলেন ১৫ বছরের অভিজ্ঞ এই নির্মাণ শ্রমিক।
সেগুনবাগিচায় আরেক ভবন নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত রডমিস্ত্রী মোহাম্মদ রিয়াজ (২৮) বেনারকে জানান, তাঁদের ঠিকাদার দুই বছর ধরে ১০ জন শ্রমিকের ৪৫ হাজার করে মোট সাড়ে চার লাখ টাকা আটকে রেখেছে।
তিনি বলেন, “মালিক বা ঠিকাদারের কাছে টাকা চাইতে যাই, কিন্তু তারা দেয় না, ঘুরাতে থাকে। তবুও ওনার এখানেই কাজ করি। বকেয়া টাকা পাওয়ার আশায় ছেড়ে যেতে পারি না। চলে গেলেই আমাদের অনেক কষ্টের ওই টাকা মাইর যাবে।”
“তিনি নতুন কাজ পায়, বাড়ি করে; কিন্তু আমাদের টাকা দেয় না,” আক্ষেপ রিয়াজের।
আট বছরের অভিজ্ঞ এই নির্মাণ শ্রমিক আরো বলেন, “আমাদের কেউ শ্রমিক ইউনিয়ন চিনতাম না, আমরা কোনো সংগঠনে নেই– এজন্য কিছু করতে পারি না। তাছাড়া সংগঠন ঠিকাদারকে অপমান করলে সে যদি আর টাকা না দেয়, সেই ভয়েও সেখানে যাই না।”
“তৃণমূলের শ্রমিকদের কাছে গিয়ে আমরাও দেখেছি সর্বত্র একই শোষণের অভিযোগ, মালিকপক্ষ টাকা দেয় না,” বলেন ইনসাব নেতা রাজ্জাক।
তাঁর মতে, “এটি একটি অসংগঠিত সেক্টর, আমাদের কাজটিও অপ্রাতিষ্ঠানিক। তাছাড়া নির্মাণ শ্রমিকদের যেহেতু কোনো নিয়োগপত্র বা নির্দিষ্ট মালিক নেই, সার্বিক বিবেচনায় আমাদের দেন-দরবার সরকারের সাথেই বেশি হওয়া উচিত।”
গত মাসে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেওয়া একেএম মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি আটকে থাকার কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। কোথাও এমনটা হলে ক্ষতিগ্রস্তরা আমাদের জানালে, আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
‘নিয়োগপত্র’ না থাকলেও শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা আত্মসাতের সুযোগ নেই উল্লেখ করে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, “শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিক রয়েছে।”
নির্মাণ শ্রমিকদের এক ‘প্ল্যাটফর্মে’ আনার প্রচেষ্টা
ইনসাব নেতারা জানান, দেশের ৩৮টি জেলা ও ৭০টি উপজেলায় ৫৭২ শাখার মাধ্যমে সর্বসাকুল্যে ৫০ হাজার নির্মাণ শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন তাঁরা। বর্তমানে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব জেলা-উপজেলায় কর্মকাণ্ড বিস্তারে সচেষ্ট আছেন।
রাজ্জাক বলেন, “মাটি কাটা, খোয়া ভাঙা, ইট ভাটা, বালু টানা শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী, রডমিস্ত্রী, টাইলস মিস্ত্রী, মোজাইক মিস্ত্রী, রং মিস্ত্রী, পলিশ মিস্ত্রী, গ্রিল মিস্ত্রী, থাই মিস্ত্রী, ইলেক্ট্রনিকস মিস্ত্রী, স্যানিটারি মিস্ত্রী – এ ধরনের ১২-১৩ ক্যাটাগরিতে নির্মাণ শ্রমিক চিহ্নিত করে আমরা সংগঠনের সংবিধানটি এমনভাবে তৈরি করেছি, যাতে সবাইকে একটা ‘প্ল্যাটফর্মে’ আনা যায়।”
“যেসব জায়গায় আমরা সক্রিয় রয়েছি সেখানে শ্রমিকদের আটকে থাকা এবং দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার খরচ আদায় শুরু করতে পেরেছি,” বলেন তিনি।
বর্তমানে দক্ষ নির্মাণ শ্রমিকরা দৈনিক সাতশ থেকে সাড়ে সাতশ, সহকারীরা পাঁচশ বা চারশ থেকে সাড়ে চারশ এবং নতুনরা তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা মজুরি পান।
ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর কর্মস্থল
ইনসাব নেতারা বলেন, শ্রম আইনের শর্তানুযায়ী কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত হওয়ার কথা। কোনো নির্মাণ প্রকল্প শুরু হলে সেখানে ভালো শ্রমিক ছাউনি, খাবার, পানি, বিশ্রাম ও ঘুমানোর থাকা বাধ্যতামূলক।
তাছাড়া বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথম তলা থেকেই প্রতি তলায় ‘সেফটি নেট’ (সুরক্ষা জাল) দেওয়ার বিধান রয়েছে। যাতে একজন শ্রমিক উপর থেকে পড়ে গেলেও মারা না যায়। তবে ৯০ শতাংশ ভবনের নির্মাণ প্রকল্পে এসব খেয়াল রাখা হয় না বলে অভিযোগ তাঁদের।
সরেজমিনে নেতাদের কথার সতত্যা মিলেছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নির্মাণ প্রকল্পে নির্মিত অধিকাংশ শ্রমিক ছাউনির অবস্থা খুবই নাজুক।
“এখানে আমাদের থাকার পরিবেশ ভালো না। সারাদিন কষ্ট করে একটু ভালো জায়গায় না ঘুমালে পরদিন সকালে শরীরে আর কাজ করার শক্তি থাকে না। কিন্তু কোম্পানি বা মালিক এটা বুঝতে চায় না। যে কারণে খুবই কষ্টে আছি,” বলছিলেন রডমিস্ত্রী সুজন।
রাজমিস্ত্রী মনির জানান, অল্প কিছু ‘ডেভেলপার’ (ভূমি উন্নয়ন) কোম্পানির ভবন নির্মাণ প্রকল্পে সুরক্ষা জাল দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘খরচ বাঁচাতে’ কোনো ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার পরিবেশও একই কারণে অস্বাস্থ্যকর।
“অনেক দিন থেকেই আমরা লক্ষ করছি, ইমারত শ্রমিকরা ৪০-৪২ বছর বয়সে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দীর্ঘ দিন নির্মাণ সামগ্রীর রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্যে থাকার কারণে এমনটা হতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি,” বলেন ইনসাব সাধারণ সম্পাদক।
তাঁর দাবি, আমরা চাই নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা বিধানে সরকার ও মালিকপক্ষ নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুক।
“বেল্ট, গামবুট, হাতমোজার মতো নিরাপত্তা সরঞ্জামগুলো মালিকের কিনে দেওয়ার কথা। সেগুলো কেন দেওয়ার হচ্ছে না- সেটি দেখার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের শ্রম কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) কর্তাব্যক্তিদের। অথচ কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা জানালে তারা জানে,” বলেন রাজ্জাক।
তবে ডিআইএফই’র যুগ্ম মহাপরিদর্শক (নিরাপত্তা) ফরিদ আহম্মেদ বেনারকে বলেন, “আমরা বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শন করি এবং আমাদের নিরাপত্তা নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেই। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক করি, এমনকি মামলা দায়ের করি।”
দেশের নির্মাণ শ্রমিকরা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে নিয়োজিত আছে; অন্যদিকে প্রায় ৩০ লাখ প্রবাসী নির্মাণ শ্রমিকের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় সমৃদ্ধ হচ্ছে অর্থনীতি, এ কথা জানিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের প্রতি সরকারের আরো ‘সুনজর’ আশা করেন ইনসাব নেতারা।