জেএমবির ১০ সদস্য গ্রেপ্তার, দুই নারী জঙ্গির জবানবন্দি


2017.01.09
ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
জেএমবির ১০ সন্দেহভাজন সদস্যকে আটক করে র‍্যাব। জেএমবির ১০ সন্দেহভাজন সদস্যকে আটক করে র‍্যাব। জানুয়ারি ০৯, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

রাজধানী ঢাকার কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির ১০ সন্দেহভাজনকে আটক করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। এদের মধ্যে সাতজনই উত্তরার লাইফ স্কুল নামের একটি ধর্মভিত্তিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন।

গতকাল সোমবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনোয়ার লতিফ খান। এসময় র‍্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, “রোববার রাত থেকে সোমবার দুপুরের মধ্যে অভিযান চালিয়ে উত্তরা ও কলাবাগান থেকে ওই ১০ জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। আটকৃতরা জেএমবির ‘তামিম-সারোয়ার’ গ্রুপের সদস্য।”

আটকৃতরা হলেন; লাইফ স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম (৪৬), স্কুলের সাবেক পরিচালক জিয়াউর রহমান (৩১), বর্তমান অধ্যক্ষ মো. মিজানুর রহমান (৪৩), আবু সাদাত মো. সুলতান আল রাজি ওরফে লিটন (৪১), আল মিজানুর রশিদ (৪১), মো. কৌশিক আদনান সোবহান (৩৭), জান্নাতুল মহল ওরফে জিন্নাহ (৬০), মেরাজ আলী (৩০), মো. শাহরিয়ার ওয়াজেদ খান (৩৬) ও মুফতি আবদুর রহমান বিন আতাউল্লাহ (৩৭)।

তবে আটক হওয়া এই জেএমবি সদস্যরা কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ত নয় বলেই মনে করছে র‍্যাব। তাঁরা দাওয়াতি পর্যায়ের সদস্য।

“লাইফ স্কুলের ভেতরের একটি মসজিদে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের জঙ্গিবাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হতো। যেসব অভিভাবক তাদের মতবাদে আকৃষ্ট হতো, তাদের সন্তানকেই কেবল ওই স্কুলে ভর্তি করা হতো, ” জানান র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক।

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত লাইফ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক। স্কুলের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় কেমব্রিজ ও ইসলামিক কারিকুলাম অনুযায়ী।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ওই স্কুলটিতে সম্প্রতি পুলিশের অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ও তানভীর কাদেরীর যাতায়াত ছিল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, জঙ্গিরা ভোল পাল্টে সমাজে নিরাপদে থাকার জন্য শিক্ষকের ভাবমূর্তি নিচ্ছে।

“আমাদের সমাজে শিক্ষকদের একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেটাকেই কাজে লাগাতে চাইছে জঙ্গিরা। এ ছাড়া ধর্মভিত্তিক শিক্ষার কথা বললে বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের অনুদান পাওয়া সহজ হয়,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান।

তবে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, রূপনগরের অভিযানে মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম নিহত হওয়ার পর তাঁরা স্কুলে গিয়েছিলেন। লাইফ স্কুল কেন্দ্রিক যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের সাতজনের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে কিছুটা সন্দেহ ছিল। কিন্তু তখন তাঁকে গ্রেপ্তার করার মতো যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

“দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যেও এক ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এটা না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়,” মন্তব্য করেন অপরাধ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। বেনারকে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার করেই কেবল জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন জঙ্গিবাদ বিকাশের কারণগুলো দূর করা।

দুই নারী জ​ঙ্গির জবানবন্দি

গতকাল সোমবার দুই দফায় ১৩ দিনের রিমান্ড শেষে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে জেবুন্নাহার শিলা ও তৃষা মণি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এরপর মুখ্য মহানগর হাকিম খুরশিদ আলম তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

আদালত ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য ওই দুই নারী তাঁদের স্বামীদের দায়ী করেছেন।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রিমান্ডে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কানাডায় থাকা এক বাংলাদেশি ও ফয়সাল নামের এক ব্যক্তিকে পুলিশ এখন খুঁজছে। কানাডা প্রবাসী ওই বাংলাদেশি মেজর (অব‍.‍) জাহিদুল ইসলামকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন বলে জানিয়েছে জেবুন্নাহার।

আশকোনার সূর্য ভিলায় পুলিশি অভিযানে আত্মসমর্পণকারী দুই নারী জানিয়েছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার বিষয়টিও তাঁরা অবহিত ছিল।

“তৃষা মণির স্বামী মইনুল ইসলাম ওরফে মুসা ও ফয়সাল নব্য জেএমবির হাল ধরার চেষ্টা করছিলেন বলে তাঁরা আমাদের তথ্য দিয়েছে। তাদের দুজনকেই ধরার চেষ্টা চলছে,” বেনরাকে জানান সহকারী উপকমিশনার আব্দুল মান্নান, যিনি জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নেন।

জঙ্গি জীবন সম্পর্কে যা জানিয়েছে দুই নারী

মেজর (অব) জাহিদুল ইসলাম ধার্মিক ছিল। সেনাবাহিনীতে থেকে ধর্ম-কর্ম করতে পারছে না বলে শিলাকে জানায় জাহিদুল। শিখা অনির্বাণে স্যালুট করার বিষয়টি তার কাছে ছিল শিরক।, জানায় জেবুন্নাহার শিলা।

এর মধ্যেই ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মেজর জাহিদ এক লাখ টাকা বেতনে লেক হেড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে চাকরি নেয়। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে তারা উত্তরায় চলে যায়।

উত্তরায় মেজর জাহিদুল ইসলাম ও জেবুন্নাহার শিলারা যে ভবনে ছিল, সেখানে অন্য তলায় মঈনুল ইসলাম মুসা ও তৃষা মণি থাকত। জিজ্ঞাসাবাদে তৃষা মণি জানায়, সে কখনই মঈনুল ইসলাম মুসার জঙ্গি কার্যক্রমে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেনি।

একই সময়ে তানভীর কাদেরি ও তাঁর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা আশাও ছিল উত্তরা এলাকায়।

জিজ্ঞাসাবাদে জেবুন্নাহার শিলা ও তৃষা মণি জানায়, মেজর জাহিদ ইসলাম, মঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা, তানভীর কাদেরি ও ফয়সাল নিয়মিত উত্তরার ইংরেজি মাধ্যম ইসলামি স্কুলে যাতায়াত করত। তারা সকালে লাইফ স্কুলের মাঠে জগিং করত, স্কুলের পার্কিংয়ে জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ত।

মঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা ও ফয়সাল দুজনেই ছিল লাইফ স্কুলের শিক্ষক। পুলিশ বলছে, ওই চারজনই ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে উত্তরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

“অভিযান চলার সময় তৃষা মণি আমাদের সাহায্য করেছে। প্রথমে জেবুন্নাহার শিলা মুখ খুলছিল না। পরে সেও কথা বলেছে,” বেনারকে জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

জেবুন্নাহার শিলা ও তৃষা মণিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, জেবুন্নাহার এখন সঠিক পথে যেতে চায়। সে অনুতপ্ত।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রাপ্তি রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।