ভারতের সঙ্গে ১৭ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই
2017.10.04
ঢাকা

কোনো দেশকে দেওয়া ভারতের এ যাবত কালের সর্বোচ্চ ঋণচুক্তিটি বাংলাদেশের সাথে বুধবার ঢাকায় সই করেছে ভারত। ৪৫০ কোটি ডলার বা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা মূল্যের এই ঋণে বিদ্যুৎ, রেলপথ, সড়ক, জাহাজ চলাচল, বন্দরসহ অবকাঠামো খাতে ১৭টি অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ।
সফররত ভারতীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে বুধবার বেলা ১১টায় সচিবালয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আজম ও ভারতের এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড রাজ কুইনা নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে সই দেন।
কোনো দেশকে ভারতের দেওয়া ঋণের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ ঋণ বলে জানিয়েছেন অরুণ জেটলি। এর আগে আরও দুটো লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত মোট তিনশ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল, যার মাধ্যমে ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ।
এক শতাংশ হার সুদের এই চুক্তির মাধ্যমে সাত বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো বড় ধরনের ঋণ দিলো ভারত। এ নিয়ে গত ছয় বছরে বাংলাদেশকে ভারতের দেওয়া মোট এলওসি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ ভারতীয় ঋণের ঘোষণা দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আজম বেনারকে বলেছেন, “কোনো ঋণচুক্তির আওতায় এটিই হচ্ছে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বড় ঋণ। এর আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে ১ হাজার ১৩৮কোটি ডলারের (১১ দশমিক ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার) ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ।”
ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক
ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পর এক বিবৃতিতে ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেন, “ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যা সাম্প্রতিককালে ক্রমবর্ধমান। ভারতের স্বার্থে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং আমরা আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ গভীর করতে, বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
এর আগে অর্থমন্ত্রী মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করেন জেটলি। বৈঠকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
শর্তের কারণে প্রকল্পের মান নিয়ে সংশয়
আগের দুটি এলওসির মতো তৃতীয় এলওসির শর্ত একই। আগের মতোই ঋণের টাকায় পূর্তকাজের প্রকল্প হলে ৬৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। অন্য প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। আর ঋণের সুদহার ১ শতাংশ, প্রতিশ্রুত মাশুল আধা শতাংশ।
“এ ঋণের সুদ হার অনেক কম। পাঁচ বছর রেয়াত সময়সহ ২০ বছরে পুরো টাকা পরিশোধ করতে হবে,” সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে ৭৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে কেনার শর্ত থাকায় প্রকল্পের মান ঠিক থাকবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষক মুস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “পণ্য কেনার সময় তারা (ভারত) ৫০ টাকার জিনিসের দাম ৬০ টাকা ধরলেও সেখান থেকেই কিনতে হবে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে অন্যদেশ থেকে অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে কেনার সুযোগ নেই।”
“ভারতের সাথে ২০১০ সালের পর থেকে যে ঋণচুক্তিগুলো হচ্ছে সেগুলোর শর্ত শিথিল হওয়া দরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত ৭৫ শতাংশ পণ্য তাদের দেশ থেকে কেনার শর্ত দিয়েছে। এতে বাংলাদেশে প্রকল্পের মান ঠিক থাকবে না,” বেনারকে বলেন তত্ত্বাবধায় সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জা এবি আজিজুল ইসলাম।
অর্থ ছাড় হয়নি আগের ঋণের
বাংলাদেশের সাথে ভারতের আগের দুটি এলওসিতে মোট ৩০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত জুন মাস পর্যন্ত প্রথম ঋণের মাত্র ৩৫ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৮টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের ঋণের আওতায় কোনো প্রকল্পে অর্থ ছাড় হয়নি।
“আগের ঋণই ছাড় দেয়নি, নতুন চুক্তি করে লাভ কী?” মন্তব্য করে আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন “২০১০ সাল থেকে যেসব ঋণচুক্তি হয়েছে সেগুলো ছাড় করার ব্যাপারে সরকারকে নজর দিতে হবে।”
তবে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেছেন, “প্রথম ধাপে নেওয়া এক বিলিয়ন ডলার ঋণের পুরোটাই বাস্তবায়ন হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। এগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আছে।”
“এবার তৃতীয় ধাপের ঋণ যথাযথভাবে ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। মূলত এ ঋণের অর্থ ব্যয় হবে অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে,” অর্থমন্ত্রী জানান।
২০১০ সালের ৭ আগস্ট ভারতের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি হয়। পরে অবশ্য ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার অনুদানে রূপান্তর করে ভারত।
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার দ্বিতীয় সমঝোতা চুক্তি হয়।
পরে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। এ ঋণের আওতায় ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় বাংলাদেশ।
অগ্রাধিকার প্রকল্পসমূহ
ঋণের টাকা কাজে লাগানোর জন্য সরকার ১৭ টি প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করেছে। ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে থাকছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা বন্দরের বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার ও তীর সংরক্ষণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নতকরণ।
এ ছাড়া থাকছে বেনাপোল-যশোর-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙা সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, চট্টগ্রামে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, ঈশ্বরদীতে কনটেইনার ডিপো নির্মাণ, কাটিহার-পার্বতীপুর-বরনগর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন তৈরি, মোংলা বন্দর উন্নয়ন, চট্টগ্রামে ড্রাই ডক নির্মাণ, মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত চার লেনে সড়ক উন্নীত করা, মোল্লাহাটে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, মিরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন, কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ প্রকল্প।