ভাষা বিতর্ক থেকে গোর্খা রাজ্যের দাবিতে অগ্নিগর্ভ দার্জিলিং

পরিতোষ পাল ও ঝুমুর দেব
2017.06.15
কলকাতা ও গৌহাটি, ভারত
দার্জিলিংয়ে মোর্চা সমর্থক ও পুলিশ মুখোমুখি। দার্জিলিংয়ে মোর্চা সমর্থক ও পুলিশ মুখোমুখি। জুন ১২, ২০১৭।
বি. মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সব স্কুলে বাংলা ভাষা পড়ানোর সিন্ধান্তের প্রতিবাদ থেকে আলাদা গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে গোর্খা অধ্যুষিত দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চল।

গত সপ্তাহ থেকেই দার্জিলিংয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে যে সংঘাত চলছিল তা মোর্চাার ডাকা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমশ চরমে পৌঁছেছে।

বৃহস্পতিবার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুংয়ের বাড়ি ও সংলগ্ন অফিসে পুলিশের তল্লাশি চালানোর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে দার্জিলিং।

স্থানীয় সাংবাদিকদের সুত্রে বলা হয়েছে, মোর্চা সমর্থকদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে কালিম্পং ও কার্শিয়াংয়েও। মোর্চা সমর্থকেরা আগুন ধরায় পুলিশ ফাঁড়িতে। ঘেরাও করে রাখা হয় পুলিশকর্মীদের। বিভিন্ন জায়গায় চলে রাস্তা অবরোধ। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে।

এতে মোর্চার কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা যায়।

“যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার আমাদের দাবি মেনে নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধর্মঘট চলবে”, বেনারকে বলেন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি।

পাশপাশি তিনি পর্যটকদের প্রতি রাজ্যের এই অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ পরিকল্পনা না কারা আহ্বান জানান।

গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থকদের আগুনে পুড়ছে পুলিশের গাড়ি। দার্জিলিং, জুন ৮, ২০১৭।
গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থকদের আগুনে পুড়ছে পুলিশের গাড়ি। দার্জিলিং, জুন ৮, ২০১৭।
বি. মুখার্জি
একশো বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে বসবাসকারী গোর্খা জনসংখ্যা ৫০ লাখের কাছাকাছি।

দার্জিলিং ও আশপাশের এলাকার এই নেপালি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাজ্যের দাবিতে কয়েক দশক ধরে আন্দোলন করে আসছে।

সর্বশেষ মে মাসের মাঝামাঝি বাংলাকে রাজ্যের সব স্কুলে বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সিন্ধান্তের পর গোর্খারা আলাদা রাজ্যের দাবিতে আবারো সোচ্চার হয়ে ওঠে, যা চরম রূপ নেয় চলতি মাসের ৮ তারিখের পর।

“গোর্খাদের একটি পৃথক রাজ্যই একমাত্র সমাধান। ভারতবর্ষে বসবাসকারী সব গোর্খাদের দাবি এটি। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবার জন্য কেন্দ্রিয় সরকারকেও আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি,” বলেন রোশন গিরি।

তিনি বলেন, গোর্খা জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গের লোকজন থেকে জাতিগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা, এই প্রেক্ষাপটেই আমরা পৃথক রাজ্যের দাবি জানাচ্ছি।

তবে গোর্খাদের আলাদা রাজ্যের দাবির বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অবস্থান হচ্ছে ‘প্রশ্নই ওঠে না’ জাতীয়।

“আমরা দার্জিলিংয়ের সমস্যা সমাধানের জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপই নিচ্ছি। কিন্তু দার্জিলিং পশ্চিমবঙ্গের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমরা এর এক ইঞ্চি পরিমাণও ভাগ হতে দেবো না।” বেনারকে বলেন রাজ্য পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব।

“এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে” তিনি বলেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর ৮ জুনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজ্যের সব স্কুলে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে মে মাসের ১৫ তারিখ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এক বিবৃতিতে বিষয়টি ‘স্পষ্টিকরণ’ করেছিলেন যে দার্জিলিংয়ের স্কুলগুলোতে বাংলা নির্দেশনা ঐচ্ছিক হবে।

কিন্তু তারপরও গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন সমর্থকদের বক্তব্য হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্নতা জরুরি।

“ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা এখনও নেপালি হিসাবে পরিচিত। দেশে আমাদের নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের একটি পৃথক গোর্খাল্যান্ড প্রয়োজন।” বেনারকে বলেন মুম্বাইর সফটওয়ার পেশাজীবী পুরন গুরুং।

তিনি বলেন “আমরা ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতা চাচ্ছি না। আমরা কেবল পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্নতা চাই, কারণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র মিল নেই।”

অস্ত্র উদ্ধার

সহিংসতার নিন্দা করলেও গোর্খাদের জন্য পৃথক রাজ্যের বিষয়টি আলোচনায় আসা উচিত বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৌমিত্র মোহন।

এ বিষয়ে মোহন তাঁর ব্লগে লেখেন, “যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত তা হলো, রাজ্যটি কতটা গ্রহণযোগ্যভাবে পরিচালিত হবে এবং এরকম একটা নতুন রাজ্য ভৌগলিক ও অর্থনৈতিকভাবে কতটা যুক্তিযুক্ত।”
এদিকে মোর্চার সহকারী সাধারণ সম্পাদক বিনয় তামাঙ্গ পুলিশি অভিযানকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে জবরদস্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “তারা কয়েকটা তির ধনুক এবং বাজি পেয়েছে, সবগুলোই স্থানীয়দের বাড়িঘরে পেয়েছে।”

পুলিশ যখন সেখানে হানা দেয় তখন স্থানীয় একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতার জন্য তির ধনুকগুলো জড়ো করা হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।

তবে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা সাংবাদিকদের বলেন, “মোর্চার সদর দপ্তর এবং পাতলেবাসে গুরুংয়ের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়ে বিপুল পরিমাণ তির-ধনুক, বাজি, বেসবল ব্যাট, অত্যাধুনিক ধনুক, আগ্নেয়াস্ত্র, দুই ব্যাগভর্তি রুপি, দূরবিন, প্রচুর মোবাইল এবং রেডিও সেট উদ্ধার করেছে।”

তিনি বলেন, “মোর্চার দপ্তর থেকে উদ্ধার অস্ত্রগুলি ট্র্যাডিশনাল নয়, পুলিশের উপর হামলার জন্য মজুত রাখা হয়েছিল।”

মোর্চা যে সেগুলি ট্রাডিশনাল বলে দাবি করছে তার পুরোটাই ভ্রান্ত বলে জানিয়েছেন তিনি।

অনুজ শর্মা বলেন, “পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখতে পুলিশ সবরকম চেষ্টা করবে”।

পুলিশি অভিযানের পর থেকেই মোর্চার শীর্ষ নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা।

এদিকে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি দার্জিলিংয়ের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য মোর্চা, কেন্দ্রিয় সরকার ও রাজ্য সরকারের একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক জরুরি বলে দিল্লিতে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

“যা হচ্ছে তা আইন শৃঙ্খলার সমস্যা নয়। এটা রাজনৈতিক সমস্যা।”

সাংবাদিকদের বলেন রোশন গিরি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।