মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অপহরণ চক্রের ছয় সদস্য শরিয়তপুরে গ্রেপ্তার

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.05
ঢাকা
201005_Bangladeshi_Abductors_620.jpeg মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়কারী বাংলাদেশ চক্রের তিন সদস্যকে (মাঝখানে) গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় গণমাধ্যমের সামনে হাজির করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। ৫ অক্টোবর ২০২০।
[সৌজন্যে: সিআইডি]

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করার কথা সোমবার জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

ওই ছয়জনকে শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জানিয়ে সিআইডির মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক বেনারকে বলেন, আটককৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। আদালত সবার জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

তাঁর তথ্যমতে, গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন; মো. রাসেল খন্দকার (২৮), শাহানাজ বেগম (৩৫), সুমন ভুঁইয়া (২৫), মো. বেলাল বিন কারি (৫৭), মো. আরিফ হোসেন (৩০) এবং মো. জাবেদ হোসেন (৩০)।

কী অভিযোগে আটক?

এ বছর ১৮ জুন মালয়েশিয়ার পুটুং এলাকায় অপহৃত হন শরিয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার প্রবাসী শ্রমিক জাহাঙ্গীর মল্লিক (৩০)। তাঁকে চোখ বেঁধে আটকে রাখা হয় একটি গোপন স্থানে।

জাহাঙ্গীরের বড় ভাই মো. আলমগীর বেনারকে বলেন, “সেখান থেকে আমাকে ফোন করে মুক্তিপণ হিসাবে দশ লাখ টাকা দাবি করে অপহরণকারীরা। টাকা না দিলে তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।”

তিনি বলেন, “আমাকে ফোনের লাইনে রেখে আমার ভাইকে নির্যাতন করতে থাকে। এরপর জাহাঙ্গীরকে ফোন ধরিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর আমাকে বলে, টাকা বড় কথা নয়; আমার জীবন আগে। ‘দরকার হলে জমিজমা বিক্রি করে আমাকে মুক্ত করো’ বলে কাঁদতে থাকে আমার ভাই।”

আলমগীর বলেন, “ওদের কথামতো আমি স্থানীয় কয়েকটি বিকাশ নম্বরে আট লাখ টাকা পরিশোধ করি। টাকা দেয়ার একদিন পর তারা আমার ভাইকে অজ্ঞান অবস্থায় পুটুং এলাকার জঙ্গলে ফেলে পালিয়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে সে তার কর্মস্থলে ফিরে যায় এবং আমাকে ফোন করে জানায় সে বেঁচে আছে।”

তিনি বলেন, “এই ঘটনায় আমি ৪ জুলাই জাজিরা থানায় মামলা করি।”

মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ওই মামলা হবার পর এর তদন্তের দায়িত্ব পড়ে সিআইডির ওপর। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভিযুক্তদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে।

জিসানুল হক জানান, এই অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী মালয়েশিয়া প্রবাসী চাঁদপুরের কামরুল। তাঁর প্রধান সহযোগী হলেন তাঁর শ্যালক ও এজাহারভুক্ত আসামি রহিম সরদার। তাঁদের এখনও আটক করা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্র। এই চক্রের মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত সদস্যরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের অপহরণ করে আটক রেখে মারধর করার ভিডিও বাংলাদেশি স্বজনদের দেখিয়ে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করে।

জিসানুল বলেন, গ্রেপ্তারকৃত বাংলাদেশি সহযোগিরা দেশে বিকাশ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়।

“এভাবে প্রবাসী শ্রমিকদের অপহরণ করে নির্যাতনের মাধ্যমে টাকা আদায় মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখা যায়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অপহরণের সাথে বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ততা নতুন প্রবণতা।”

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের এটি দ্বিতীয় ঘটনা বলে জানান জিসানুল হক।

মূল অভিযুক্তদের ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকারকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে বলেন, প্রবাসী শ্রমিকদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের সাথে যুক্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার একটি ভালো খবর বলা যায়।

তিনি বলেন, তবে যারা বাংলাদেশে ধরা পড়েছে তারা আসলে চুনোপুঁটি। এদের যে মূল হোতা তারা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

সাইফুল হক বলেন, “লিবিয়াতে আমরা যেমন মানবপাচার ও অপহরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করি মালয়েশিয়াতে তেমন ঘটনা ছিল না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এগুলো সেখানেও ঘটছে। এর অন্যতম কারণ হলো, করোনাভাইরাসের কারণে মালয়েশিয়ার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তেমন তৎপর নয়। আবার অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অপহরণকারীরা।”

তিনি বলেন, “বিশ্বের ১৬০টি দেশে বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে বলে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়ে তেমন কোনও দেশের সাথে আমাদের চুক্তি নেই। কিছু কিছু দেশের সাথে সমঝোতা স্মারক রয়েছে। সে কারণে আমাদের কর্মীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হন।”

সাইফুল হক বলেন, এখানে বাংলাদেশিদের অপহরণ করা হলেও এর সাথে বিভিন্ন দেশের অপরাধীরা সংযুক্ত। শুধু বাংলাদেশিদের পক্ষে এককভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র সামাল দেয়া সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান অনেক। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পরেই বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। ১৯৭৬ সালের পর থেকে ১০ লাখের বেশি শ্রমিক সেখানে কাজ করতে গেছেন।

সরকারি হিসেবে, বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।