রায় পরিবর্তনের জন্য চাপ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী: এস কে সিনহা
2018.09.20
ওয়াশিংটন ডিসি

সরকারের পছন্দমতো রায় লিখতে রাজি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা এবং চাপ দিয়ে দেশত্যাগ ও পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ এনেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
একই সাথে তাঁকে চাপ ও হুমকি দেওয়ার জন্য সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে (ডিজিএফআই) তাঁর সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনীতে অভিযুক্ত করেন তিনি।
“শেষ পর্যন্ত, আমার পরিবারের ওপর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর চাপ ও হুমকির মুখে আমি দেশের বাইরে থেকে পদত্যাগপত্র জমা দেই,” বইয়ের ভূমিকায় বলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা।
এ প্রসঙ্গে ‘বই না পড়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়,” জানিয়ে ডিজিএফআইর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমি এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, কাউকে হুমকি দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়। ডিজিএফআই কখনো এটা করে না।”
ইংরেজিতে লেখা এস কে সিনহার ৬১০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম- রুল অব ল, হিউমেন রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ বইটির অনলাইন ভার্সন চলতি সপ্তায় প্রকাশ করেছে অ্যামাজন।
তবে দেশান্তর ও পদত্যাগ সম্পর্কে এস কে সিনহা তাঁর বইয়ে একেবারে “মনগড়া” কথা লিখেছেন বলে বৃহস্পতিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্যে এটি দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার যে, তাঁকে বন্দুকের নলের মুখে দেশত্যাগ ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল, যা প্রমাণ করে বিচার বিভাগ হুমকির মুখে।”
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে ২০১৭ সালে দেওয়া রায়ে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত করা হয়। জুলাই মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই প্রধান বিচারপতির সাথে সরকারের দ্বান্দ্বিক অবস্থার তৈরি হয়।
এই সময় প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যেই প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি ‘বিব্রত’ জানিয়ে ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন প্রধান বিচারপতি সিনহা।
এরপর নভেম্বরের ১০ তারিখ অস্ট্রেলিয়া থেকে কানাডা যাবার পথে যাত্রা বিরতির সময় সিঙ্গপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের কাছে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন বলে বেনারকে জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন।
রায় বদলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর চাপ
বিচারপতি সিনহা তাঁর বইয়ে ২০১৭ সালের ১লা জুলাইর একটি ঘটনা উল্লেখ করেন। এতে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সারওয়ার হোসেন ওই দিন তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করে ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে জানান যে, রাষ্ট্রপতি তাঁকে আলোচনার জন্য সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বঙ্গভবনে যেতে অনুরোধ করেছেন।
নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই বঙ্গভবনে পৌঁছালে রাষ্ট্রপতির সচিব তাঁকে নিজের কক্ষে নিয়ে যান।
“এই ঘটনা আমাকে আরো হতবাক করে,” জানিয়ে এস কে সিনহা বলেন, একজন প্রধান বিচারপতির বসার জন্য সেই কক্ষ কোনোভাবেই মানানসই না হওয়ায় তিনি সেখানে ৪৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকেন।
“ওই সময় আমার মানসিক অবস্থা খুবই বিপর্যস্ত ছিল,” বলে ওই সময়কে বর্ণনা করে তিনি লেখেন, যখন তাঁকে রাষ্ট্রপতির কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় তখন, “সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।”
তিনি জানান, রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
এস কে সিনহা জানান, শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে তিনি বলেন, “এই ধরনের প্রক্রিয়াকে প্রশ্রয় দিলে আমার পক্ষে মর্যাদার সাথে বিচারব্যবস্থা পরিচালনা খুবই দূরহ হয়ে উঠবে।”
আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী “যে কোনো উপায়ে সরকারের পক্ষে রায় দেবার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন,” জানিয়ে সিনহা লেখেন, “অন্য বিচারপতিরা যদি সরকারের বিপক্ষেও মতামত দেন, তবুও সরকারের পক্ষে আমার একার মতামত দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল বারবার আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন।”
এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী অধৈর্য হয়ে উঠেন জানিয়ে তিনি বলেন, “অ্যাটর্নি জেনালের শুধু আমাকে চাপই দিচ্ছিলেন না, বরং একই সাথে আমার সিন্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য অনুরোধও করছিলেন,”
রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত চলা ওই গোপন বৈঠকের শেষ অংশটিকে “আমি খুবই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, এমনকি কাঁপছিলাম,” বলে বর্ণনা করে এস কে সিনহা লেখেন, “হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, প্রধান বিচারপতি কিছুই খাননি এবং সকালে উনার কোর্ট আছে।”
তবে “মাঝে মাঝে দুয়েকটা মন্তব্য ছাড়া রাষ্ট্রপতি আগাগোড়াই নীরব ছিলেন,” জানান সাবেক প্রধান বিচারপতি।
দেশত্যাগ ও পদত্যাগ: ডিজিএফআই’র বিরুদ্ধে অভিযোগ
বিচারপতি সিনহা তাঁর বইয়ে লেখেন, ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর দুপুর বারোটায় ডিজিএফআইর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাইফুল আবেদিন তাঁর অফিসে এসে জানান যে, “তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাই অনুসরণ করেন, সুতরাং তিনি যা বলেন সেটাকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।”
“এরপর তিনি বলেন, স্যার ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত চার মাসের ছুটি নেন।”
সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা দেশ ছাড়ার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করে লিখেন, “দেশের বাইরে আসার পর আমি আমার স্ত্রী ছাড়া কারো সাথে কথা বলতে পারতাম না, কারণ হয়রানির ভয়ে আমার কোনো কর্মকর্তা কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীও আমার ফোন রিসিভ করছিলেন না।”
“ডিজিএফআই কর্মকর্তারা অব্যাহতভাবে তাঁদেরকে হুমকি দিচ্ছিলেন। আমার সব ফোনই তাঁরা মনিটর করছিলেন।”
ব্যবসায়ী ও বেলেরুশ অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায় ঢাকা থেকে গুম হন ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট। ৮১ দিন নিখোঁজ থাকার পর বাড়ি ফেরেন ১৭ নভেম্বর।
সেই প্রসঙ্গে সিনহা লেখেন, নিখোঁজের দুদিন পর অনিরুদ্ধর স্ত্রী তাঁর বাসায় এসে জনান যে, সরকারের মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তাঁকে জানিয়েছেন, অনিরুদ্ধ সরকারের জিম্মায় রয়েছেন।
“এর মানে এটা জানা কথা যে, সে ডিজিএফআইর হেফাজতে রয়েছে,” লিখে সিনহা জানান, পরবর্তীতে লে. কর্নেল নাজিমুদ্দৌলা অনিরুদ্ধ তাঁদের জিম্মায় থাকার বিষয়টি তাঁকে নিশ্চিত করেন।
নভেম্বরের ১০ তারিখ সাবেক প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া থেকে কানাডা যাবার পথে সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতি করেন। ওই সময় রাত আড়াইটার দিকে তাঁর হোটেলক্ষে লে. কর্নেল নাজিমুদ্দৌলা দেখা করে অনিরুদ্ধ সম্পর্কে তাঁকে জানান, “স্যার ডিজিএফআই তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে।”
“তিনি আমাকে এও জানান যে, আমি যদি পদত্যাগ না করি, তবে ডিজিএফআই এবং অসৎ লোকেরা আবারো অনিরুদ্ধকে তুলে নিয়ে যাবে।”
“আমি তাঁকে জানাই, আমি আমার স্ত্রী আর মেয়েদের সাথে কথা না বলে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না।”
এছাড়া তিনি কানাডায় গিয়ে সিন্ধান্ত নেবার কথা বললেও ডিজিএফআইর লে. কর্নেল নাজিমুদ্দৌলা রাজি হন না।
ততক্ষণে ভোর পাঁচটা হয়ে গেছে এবং তাঁর কানাডার ফ্লাইট ছিল সকাল আটটায়। নাজিমুদ্দৌলা তাঁকে জানান, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছেন।
এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি সিনহা অস্ট্রেলিয়া থেকে লিখে নিয়ে আসা পদত্যাগপত্রটি হস্তান্তর করলে নাজিমুদ্দৌলা সেটি ফোনে উচ্চপদস্থ কাউকে পড়ে শোনান।
এরপর ফোনের অন্যপাশ থেকে পদত্যাগপত্রের কয়েকটি ভাষা পরিবর্তনের পরামর্শ আসলে সিনহা তা করতে অস্বীকৃতি জানান।
এরই মধ্যে নাজিমুদ্দৌলা অনিরুদ্ধর সাথে কথা বলার জন্য তাঁকে ফোন ধরিয়ে দেন।
“আমি অনিরুদ্ধর গলা শুনতে পাই, সে আমাকে বলে, স্যার আমার প্রতিবন্ধী ছেলেটার মুখ খেয়াল করে অফিসারের কথামতো পদত্যাগপত্রটি স্বাক্ষর করেন।”
এরপর সংশোধিত পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
“বিচারপতি সিনহা দেশত্যাগের পর বিচার বিভাগের প্রতি জন আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা গেছে। তিনি চলে যাওয়ার পর সরকার প্রণীত নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি বিধি সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করার ফলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে জন আস্থায় ভাটা পড়েছে,” বেনারকে বলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ড. শাহদীন মালিক।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী এবং বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বেনারকে বলেন, “এসবের মাধ্যমে সরকার দেশের সকল বিচারকদের জন্য একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। সেটি হলো কোনো বিচারক যদি সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করেন, তবে তাঁদেরও বিচারপতি সিনহার ভাগ্য বরণ করতে হবে। এটি দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি ভয়াবহ বার্তা। দেশের অন্যান্য বিচারকেরাও এখন চাপের মধ্যে রয়েছেন।”
অমর্যাদার উদ্বাস্তু জীবন, বাংলাদেশে কি নিরাপদ?
“আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে আমাকে জোর করে দেশছাড়া করা হবে।”
নিজের উদ্বাস্তু জীবনের শুরু সম্পর্কে এভাবেই বলেন এস কে সিনহা, “কোনো টাকা পয়সা ছাড়া মাত্র একটি স্যুাটকেস সাথে নিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হই আমি।”
দেশ ছেড়ে তিনি প্রথমে কিছুদিন অস্ট্রেলিয়ায় বড়ো মেয়ের কাছে থাকেন। কিন্তু “কোনো মর্যাদাবান পিতামাতা অনির্দিষ্টকালের জন্য মেয়ের পরিবারের সাথে থাকতে পারে না,” উপলব্ধি থেকে তিনি কানাডায় ছোট মেয়ের কাছে গিয়ে উঠেন।
কিন্তু ছোট মেয়ের এক কক্ষের বাসায় তাঁর দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানও যুক্তিসঙ্গত নয় বিবেচনায় এরপর তিনি এসে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রে এক বাংলাদেশির বাসার বেজমেন্টে।
“আমি উদ্বাস্তু হয়ে থাকতে চাই না,” জানিয়ে অমর্যাদাকর উদ্বাস্তু জীবনে নিজেকে গুটিয়ে রাখার বর্ণনা দিয়ে এস কে সিনহা প্রশ্ন করেন, “কিন্তু আমি যদি দেশে ফিরে যাই, তবে বাংলাদেশ কি আমার জন্য নিরাপদ?
তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে পুলক ঘটক।