স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে বাড়ছে জনসমাগম, পুরোনো চেহারায় ফিরে যাচ্ছে ঢাকা
2020.05.11
ঢাকা

দেশে প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও পুরানো চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে রাজধানী ঢাকা। সংক্রমণ এড়াতে চলমান সাধারণ ছুটি শিথিল করে দোকানপাট খুলে দেওয়ার একদিনের মধ্যে সোমবার রাস্তায় জনসমাগম বেড়েছে।
বাস–মিনিবাস ছাড়া সব ধরনের যানবাহন রাস্তায় নামায় প্রায় দেড় মাস পর শহরে দেখা গেছে ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা।
একই দিনে স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, গত ২৪ ঘন্টায় তা হাজার অতিক্রম করেছে। এই সময়ে মারা গেছেন ১১ জন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে জনসমাগম এড়ানোর নির্দেশনা শিথিল করা উচিত হয়নি, এতে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, “নাগরিকদের ঘরে থাকতে সরকারের নির্দেশ শিথিল হওয়ায় রাস্তাঘাট, বাজার ও দোকানপাটে জনসমাগম বেড়েছে। জরুরি ছুটি চলার মধ্যে সবিকছু এভাবে শিথিল করা মোটেই উচিত হয়নি।”
দেশে অনেক আগেই ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ বা সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে,” মন্তব্য করে ডা. মাহবুব বলেন, “এখন পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।”
তাঁর মতে, চলতি মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছে। তাই অন্তত ঈদ পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সরকার ১০ মে থেকে সীমিত আকারে মার্কেট ও দোকানপাট খুলে দেয়। এর দ্বিতীয় দিন সোমবার প্রায় সর্বত্রই জনসমাগম লক্ষ করা যায়।
এদিকে নির্দেশনা শিথিল করার বিষয়ে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির পরামর্শ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
“এ ব্যাপারে আমাদের (কমিটির) পরামর্শ নেওয়া হয়নি,” ক্ষোভ প্রকাশ করে বেনারকে জানান ওই কমিটির সদস্য ও সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনাল।
কমিটি লকডাউন শিথিলের বিজ্ঞানভিত্তিক পন্থা সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সীমিত আকারে অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছে, তার সঙ্গে এখনকার অবস্থার মিল নেই। এখন অর্থনীতির চাকা দ্রুত ঘোরানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে।”
“এই অবস্থা করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে,” বলেন অধ্যাপক আর্সনাল।
এদিকে “গরিব, কর্মহীন ও অসহায় মানুষের জীবিকার স্বার্থে সরকার সাধারণ ছুটি কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করেছে,” বলে সোমবার এক ভিডিও বার্তায় জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তবে অনেকেই শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষা করছেন জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “দোকানপাট ও ব্যবসাকেন্দ্রসহ অনেক জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে না।”
এদিকে “যেসব ক্রেতা শপিং করতে এসেছেন তারা ‘মাস্ক’ পরে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেই কেনাকাটা করছেন,” বলে সোমবার এক ভিডিও বার্তায় জানান বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, “মার্কেটগুলোতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছি।”
জনসমাগম এড়াতে মাঠ পর্যায়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো শিথিলতা আসেনি বলে সোমবার বেনারকে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র মো. সোহেল রানা।
তবে “যেহেতু সরকার মানুষকে বাইরে আসতে অনুমতি দিয়েছে, আমরা তাঁদের ঘরে থাকার জন্য জোর করতে পারি না,” মন্তব্য করে সোহেল রানা জানান, এক সাথে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য যাতে করোনায় আক্রান্ত না হয়ে পড়েন সেজন্য কৌশলগত কারণে কিছু জায়গায় লোকবল কমানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৭৫৬ জন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই আক্রান্ত হয়েছেন ৮১০ জন।
ইতিমধ্যেই করোনাভাইরাসে মারা গেছেন সাত জন পুলিশ সদস্য।
পুরোনো চেহারায় ফিরছে ঢাকা
রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, শপিংমল বা মার্কেটগুলোর সামনে রিকশা-গাড়ির ভিড়। ফিরে এসেছেন কিছু এলাকার ফুটপাতের হকারেরা।
দোকানপাট খুলে দেওয়ায় গত দুই দিন ধরে রাস্তায় রিকশা-গাড়ির চাপও বেড়েছে বলে বেনারকে জানান মিরপুরের রিকশা চালক ফিরোজ হোসেন।
মিরপুর এক নম্বরের ফুট ওভার ব্রিজ সংলগ্ন ফুটপাতে চার-পাঁচ বছর ধরে জুতা-স্যান্ডেল বিক্রি করেন জাহিদুল ইসলাম। সরকার বাধ্যতামূলক ছুটি ঘোষণার পর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে নিজের গ্রামে চলে গিয়েছিলেন তিনি। ফিরে এসে রোববার আবার দোকান খুলেছেন।
“প্রায় দেড় মাস গ্রামে থেকেছি। কিন্তু সেখানে কাজ নেই। এরই মধ্যে বাড়িওয়ালা বারবার ফোন করে ভাড়া চাইছেন, তাই চলে এসেছি,” বেনারকে বলেন জাহিদুল।
তবে তিনি জানান, ফুটপাতের ক্রেতারা এখনও নামেননি। রোববার একজোড়া স্যান্ডেলও বিক্রি হয়নি। সোমবার মাত্র এক জোড়া বিক্রি হয়েছে।
সোমবার ইসলামপুর ও বাংলাবাজার এলাকার দোকানপাট ‘মোটামুটি সবই খোলা’ ছিল বলে বেনারকে জানান পুরানো ঢাকার বাসিন্দা মুরসালীন অয়ন।
“তবে বইয়ের চেয়ে কাপড়ের মার্কেটে এখন ভিড় বেশি, অনেকটা স্বাভাবিক সময়ের মতোই,” বলেন অয়ন।
“প্রতিদিনই রাস্তায় গাড়ি এবং মানুষের ভিড় বাড়ছে। আমার বাসার পাশে একটি ভবন তৈরির কাজও রোববার পুনরায় শুরু হয়েছে, যা লকডাউন শুরুর পর থেকে বন্ধ ছিল,” বেনারকে বলেন অভিজাত এলাকা গুলশানের বাসিন্দা আমিনুল এহসান।
“বাস চলাচল শুরু হলেই রাস্তায় মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে,” বলেন মিরপুরের রিকশা চালক মো. জামাল উদ্দিন।
এদিকে “এখনও ঢাকা বিভাগ এবং রাজধানীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি,” বলে সোমবার করোনাভাইরাস বিষয়ক বুলেটিনে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ১১ জন, আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৩৪ জন।
এ নিয়ে সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৯১ ও মৃত ২৩৯ জনে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সোমবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪১ লাখ ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ৮৪ হাজারের বেশি।