করোনাভাইরাস: বস্তিতে সতর্কতা কম, ক্ষুধা নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশি
2020.05.08
ঢাকা

ঘরের দৈর্ঘ্যে বড়জোর নয় ফুট, প্রস্থে সাত ফুট। সেখানে দুটি চৌকি পাতা। একই কক্ষে বাস করেন দুই জোড়া স্বামী-স্ত্রী। প্রথম দম্পতি বাবা-মা এবং দ্বিতীয় দম্পতি তাঁদের ছেলে ও পুত্রবধু। সেখানে আরও একাধিক শিশুর বসবাস।
“সরকার বলে ঘরে থাকতে। আমাদের কি ঘরে থাকার অবস্থা আছে?” নিজের খুপড়ি ঘর দেখিয়ে বেনারকে বলেন সাবিহা বেগম (৫২)।
তাঁর প্রশ্ন—সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখব কীভাবে? থাকার এইটুকু জায়গা, কাজ নেই, খাবারের অভাব। এ ছাড়া সমস্যার তো শেষ নেই।
“আমাদের টাকা দিয়ে বাথরুম যাওয়া লাগে। অনেক দূরে বাথরুম। সেখান থেকেই আবার পানি টেনে আনতে হয়,” বলেন সাবিহা।
তেজগাঁও রেল স্টেশনের কাছে আয়নালের বস্তিতে বৃহস্পতিবার কথা হয় সাবিহার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় এগিয়ে আসনে আরেক নারী।
“করোনা শুরুর আগে বিভিন্ন বাসায় কাজ করতাম। এখন কোনো বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না। এ জন্য আয়-রোজগার নেই,” বেনারকে বলেন জরিনা বেগম (৩৮)।
ছোট এই বস্তিতে প্রায় ছয়শ লোকের বসবাস। গত প্রায় দুই মাস ধরে বস্তির উপার্জনক্ষম লোকেরা বসা। ঘরে থাকার সুযোগ নেই। কারণ ঘরটুকু কেবল ঘুমানোর জায়গা। তাই বস্তি থেকে বের হয়ে আশপাশে ঘোরাঘুরি করে দিন কাটছে তাঁদের।
নুরুল ইসলামের বয়স প্রায় ৬০ বছর। অসুস্থতার কারণে তিনি আর কাজ করতে পারেন না।
“আমার ছেলে রিকশা চালায়। কিন্তু এখন চালাতে দিচ্ছে না। রাস্তায় বের হলে পুলিশ মারে,” বেনারকে বলেছেন তিনি। খাবার, ওষুধসহ নানা খরচের হিসাব দিয়ে তিনি বললেন, এখন জীবন চালানো কঠিন। করোনা নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই।
বস্তির বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাঁরা সরকারি ত্রাণ যেটুকু পান তা অপর্যাপ্ত। স্থানীয় একটি ক্লাবসহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাঁদের ত্রাণ দিয়েছে।
তবে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামীম হাসান বেনারকে বলেছেন, “প্রত্যেক বস্তি ঘুরে ঘুরে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। পরিমাণ কম হতে পারে, কিন্তু সবাইকে দেওয়ার চেষ্টা আছে।”
‘সঙ্গে আছি’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা করোনা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন বস্তিতে ঘুরে চাল, ডাল, আলুসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণ করছেন।
ওই সংগঠনের সভাপতি জসিম উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, “যাদের কষ্টের কথা বলছেন, তাঁদের কষ্ট চিরদিনের। তবে জরুরি ছুটির এই সময়ে খাবারের অভাবে গরিব মানুষ মারা যাবে—এমন বাস্তবতা এখন আর নেই। যদি কেউ থানায় গিয়ে জানায় তার খাবার নেই, তাহলে পুলিশ তার ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনও কিছু কাজ করছে।”
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন বেনারকে বলেন, ৯৯৯ নম্বরে ফোন কল ও ক্ষুদেবার্তা পেলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা করোনার এই সময়ে উপার্জন করতে পারছেন না, এমন নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য এই সেবা চালু আছে।
তবে ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা আছে।
চলমান সংকটে ত্রাণ বিতরণে অভিজ্ঞতা অর্জন করা জসিম উদ্দিন খান বলেন, “এটা সত্য যে, ঢাকায় ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের অভাব আছে। একেক সংগঠন একেকভাবে ত্রাণ বিতরণ করে। আবার একই জায়গায় অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন ত্রাণ দেয়। ফলে কেউ অনেক পায়, কেউ কিছুই পায় না। অভাবী এবং ভাসমান মানুষের ডেটাবেজ তৈরি থাকলে এই সমন্বয়হীনতা থাকত না।
গত বছরের ১৯ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জাতীয় সংসদকে জানান, ঢাকা শহরে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তিতে ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫ জন লোক বসবাস করছেন।
রাজধানীর প্রায় সব বস্তির চেহারাও মোটামুটি একই রকম। সর্বত্রই সরু পথে ঢুকতে হয়। বস্তির ভেতরে অসংখ্য অলি-গলি, ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। নোংরা বাথরুম।
সবচেয়ে বড় কড়াইল বস্তি থেকে তেজগাঁওয়ের রেল লাইন বস্তি-সর্বত্রই একই চিত্র। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর, ভাষানটেক, আগারগাঁও, হাজারিবাগ ও মোহাম্মদপুর এলাকায় গড়ে উঠছে অসংখ্য বস্তিু। যদিও এসব বস্তির বাসিন্দাদের একটি অংশ লম্বা ছুটির সুযোগে গ্রামে চলে গেছেন।
একাধিক বস্তি ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের পাহারা, সেনা সদস্যদের টহলসহ নানা কারণে বস্তির বেশিরভাগ মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছেন মাস্ক পরে। কিন্তু বস্তির ভেতরে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সেখানে কেউ মাস্ক পরছেন না এবং সামাজিক দুরত্ব মানার কোনও ব্যাপার নেই।
এসব বস্তির বেশিরভাগ মানুষ রিকশাচালক, গার্মেন্টস কর্মী, হকার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও গৃহকর্মী।
সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনাভাইরাসের সবচেয়ে ঝুঁকির জায়গা হচ্ছে বস্তি। সেখানে একজন সংক্রমিত হলে দ্রুত তা বস্তিতে ছড়িয়ে পড়বে। গত ৮ এপ্রিল রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় একটি বস্তিতে করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর সেটি লকডাউন করে দেয় পুলিশ। তবে নতুন করে আর কোথাও সংক্রমিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
“জনস্বার্থ বিবেচনায় একজন চিহ্নিত হলে পুরো বস্তি লকডাউন করার বিকল্প নেই,” বলেছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর।
“বস্তিতে দূরে দূরে বসবাসের কোনো সুযোগ নেই-এটা ঠিক। তবে কেউ আক্রান্ত হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নিতে হবে। কোনো বস্তিতে সংক্রমণ পাওয়া গেলে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে তা ছড়িয়ে পড়বে,” বেনারকে বলেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বলেছেন, “সংক্রমণ থেকে বস্তিগুলোকে মুক্ত রাখাটাই এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু আমাদের এখানে চাইলেও সবাইকে করোনা পরীক্ষা করার সুযোগ নেই।”
মৃতের সংখ্যা দুইশ অতিক্রম
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০৯ জন এবং মারা গেছেন সাত জন।
এ নিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১৩৪ ও মৃত ২০৬ জনে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, শুক্রবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯ লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ৭৩ হাজারের বেশি।