জলবায়ু উদ্বাস্তু: ঢাকার বাইরে পুনর্বাসনের উদ্যোগ
2021.07.06
ঢাকা

জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তচ্যুত মানুষদের ঢাকামুখী স্রোত ঠেকিয়ে দেশের অন্যান্য মহানগর ও জেলা সদরে পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক।
দেশের ইতিহাসে এ ধরনের প্রথম উদ্যোগে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে জার্মান উন্নয়ন ব্যাংক। ওই উদ্যোগের আওতায় খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সাতক্ষীরা ও সিরাজগঞ্জ শহরের বস্তিগুলোর অবকাঠামো ও সেবা উন্নয়নের পাশাপাশি সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যার লক্ষ্য জলবায়ু উদ্বাস্তুরা ঢাকার বাইরের ওই শহরগুলোতে যেন থাকতে আগ্রহী হয়।
ঢাকাভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাণ্ড ডেভেলেপমেন্টের (আইসিসিসিডি) হিসেবে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে ৪১ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে বাস্তচ্যুত হয়েছে এবং তাদের একটি বড় অংশ ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে।
সংস্থাটির উপপরিচালক মিজান রহমান খান বেনারকে বলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা হতে পারে এক কোটি ৩২ লাখ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ১৮ ভাগ এলাকা ডুবে যেতে পারে।
তিনি বলেন, প্রতি বছর পাঁচ লাখ মানুষ সারা দেশে বাস্তচ্যুত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ঢাকা আর জনসংখ্যার চাপ নিতে পারবে না।
ব্র্যাকের ক্লাইমেট ব্রিজ ফাণ্ড নামে প্রায় ১২ কোটি টাকার ওই তহবিল পরিচালনাকারী সচিবালয়ের প্রধান ড. গোলাম রাব্বানী বেনারকে বলেন, “জার্মান উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে আমরা তহবিলটি শুরু করি। এর উদ্দেশ্য হলো বস্তিগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি পানি, পয়ঃনিষ্কাসন, স্বাস্থ্য সেবাসহ জীবিকার ব্যবস্থা করা।”
তিনি বলেন, “এর ফলে আশেপাশের অঞ্চলগুলোর জলবায়ু উদ্বাস্তুরা ঢাকায় না গিয়ে খুলনা ও রাজশাহী মহানগরীসহ অন্যান্য শহরে আশ্রয় নেবে।”
গোলাম রাব্বানী বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে শুধু খুলনা ও রাজশাহীতে চারটি প্রকল্প চালু হয় এবং ২০২১ সালে বরিশাল, সাতক্ষীরা ও সিরাজগঞ্জে প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
তবে প্রকল্পের সুবিধা পেতে আরও কিছুদিন লাগবে। এর কারণ করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে।
মিজান রহমান বলেন, এই প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ ভালো।
তিনি বলেন, “বাস্তচ্যুত মানুষদের মানসিকতা হলো, তাঁরা তাঁদের ঘরবাড়ির আশেপাশের কোন অঞ্চলে থাকতে চান। যেমন বৃহত্তর খুলনা মহানগরীতে যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে, সেখানে যদি ভালো অবকাঠামো ও সেবা থাকে সেক্ষেত্রে খুলনা অঞ্চলের জলবায়ু উদ্বাস্তুরা খুলনায় থাকবে। ঢাকায় আসবে না।”
নওগাঁ অঞ্চলের খরা প্রবণ এলাকা থেকে কোন মানুষ বাস্তচ্যুত হলে তাঁরা ঢাকায় না গিয়ে রাজশাহী থাকতে চাইবেন বলেন মন্তব্য করেন মিজানুর রহমান খান।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট ১৩ হাজার ৯৩৮টি বস্তি ছিল।
১৯৯৭ সালে পরিচালিত বস্তি শুমারি অনুযায়ী, দেশে তখন দুই হাজার ৯৯১টি বস্তি ছিল। অর্থাৎ ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বস্তির সংখ্যা ৩৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসব বস্তিতে ২২ লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষ বাস করেন। ১৯৯৭ সালের শুমারি অনুযায়ী, বস্তিতে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ বাস করতো।
২০১৪ সালের শুমারি অনুযায়ী, ঢাকায় সর্বোচ্চ ছয় হাজার ৪৮৯টি, চট্টগ্রামে তিন হাজার ৩০৫টি এবং খুলনায় এক হাজার ৬৮৪ টি বস্তি রয়েছে।
মিজানুর রহমান খান বলেন, ২০১৪ সালের পর থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে বস্তিতে মানুষের সংখ্যা ২০১৪ সালের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের অধিকাংশই নদী ভাঙনের শিকার অথবা জলবায়ু বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তচ্যুত হয়েছেন।
২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডরের পর ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে ৩৫ বছর বয়সী আকতারুল সানা। তাঁর বাড়ি খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি গ্রামে। সিডরের পর পরিবারের সাথে তিনি খুলনা শহরে আশ্রয় নেন। তাঁর রাজমিস্ত্রি স্বামীও একই এলাকা থেকে খুলনা শহরে আশ্রয় নিয়েছেন।
মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের গ্রামে আর থাকার উপায় নেই। লবন পানি ঢুকে গেছে, কোনও কাজ-কর্ম নেই। তাই খুলনায় চলে এসেছি। আমাদের মতো কয়রার অনেক মানুষ খুলনায় চলে এসেছে।”
সানা বলেন, খুলনায় যদি কাজের সুযোগ থাকে, ভালো পরিবেশ, সুবিধা থাকে তাহলে বাস্তচ্যুত গরীব মানুষের উপকার হবে।
জাতিসংঘের ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) পঞ্চম (২০১৪) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের মুখোমুখি হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়াও রয়েছে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য।
আইপিসিসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের দুই কোটি ৭০ লাখ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
ওই প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পাঁচ দশমিক নয় ভাগ অপচয় হয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক এই হুঁশিয়ারির পরও বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু এবং বিভিন্ন দুর্যোগে বাস্তচ্যুত মানুষদের স্থানান্তর শুরু হয়নি।
তবে সরকারের আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কক্সবাজার জেলায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
২০২০ সালের জুলাই মাসে এই ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ৬০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বসবাস করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বেনারকে বলেন, অবধারিতভাবে বলা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বিরাট সংখ্যক মানুষ বাস্তচ্যুত হবে। তাদের আশ্রয় দিতে হবে। কিন্তু সবাইকে ঢাকায় আশ্রয় দেয়া যাবে না, এটাই বাস্তবতা।
ব্র্যাকের নেতৃত্বে শুরু হওয়া প্রকল্পের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে সরকারিভাবে এখনও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পরিকল্পিতভাবে ঢাকার বাইরের শহরে নেয়ার কাজ ব্যাপকভাবে শুরু করা যায়নি। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করার কথা অবশ্যই বিবেচনা করবো।”
পরিচালক শওকত আলী বলেন, “তবে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যাঁরা ঢাকা অথবা বড় শহরে চলে আসছেন সবাই যে জলবায়ু উদ্বাস্তু তা নয়। কারা জলবায়ু উদ্বাস্তু এবং কারা অর্থনৈতিক কারণে বাসস্থান ত্যাগ করছে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।”