বড় অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেতে শেখ হাসিনার চীন সফর শুরু
2024.07.08
ঢাকা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের দ্বিপক্ষীয় চীন সফর নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত সফরের পর শেখ হাসিনার চীন সফর আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কৌশলগত ভারসাম্যের ইঙ্গিত দেয়।
তাঁরা বলছেন, ভারতের হস্তক্ষেপে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও চীনের লক্ষ্য আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্পূর্ণ বাংলাদেশের উপর রাজনৈতিক প্রভাব রাখতে চায় চীন।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “চীনের হাতে এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ রয়েছে। তারা সেটা বিনিয়োগ করার জন্যও প্রস্তুত। অন্যদিকে চলমান অর্থনৈতিক সংকট মেটাতে বাংলাদেশের মোটা অংকের অর্থ দরকার।”
চীন বাংলাদেশকে ঋণ দিতে প্রস্তুত। কারণ ঋণ দিয়ে একদিকে তারা সুদের টাকা পাচ্ছে, অন্যদিকে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনা ঠিকাদাররা এককভাবে কাজ পাচ্ছে। এতে তাদের দেশের মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের ওপরেও চীনের প্রভাব বজায় থাকছে।
চুক্তি নয় সমঝোতা
রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, “ব্যবসা ও অর্থনৈতিক খাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে।”
তবে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য কোনো চু্ক্তি নয় একটি সমঝোতা স্মারক হবে বলে জানান তিনি।
“যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রয়োজনের নিরিখে এবং সব শর্ত পূরণ হলে ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতা হবে,” বলেন হাছান মাহমুদ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী্র এবারের বেইজিং সফরে দু দেশের মধ্যে কোনও চুক্তি হবে না। তবে ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক সইয়ের পাশাপাশি কিছু প্রকল্পের উদ্বোধন হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিপল টু পিপল কানেক্টিভিটি প্রভৃতি রয়েছে সমঝোতা স্মারকের তালিকায়।
এদিকে গত সপ্তাহে ব্লুমবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, রিজার্ভ বাড়াতে এবং চীনের কাছ থেকে কেনাকাটার জন্য সহায়তা হিসেবে ৫০০ কোটি (পাঁচ বিলিয়ন) ডলারের সমপরিমাণ চীনা মুদ্রা চেয়েছে বাংলাদেশ।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে এ বিষয়ে বেইজিংয়ের কাছ থেকে নতুন ঘোষণা আসতে পারে।
সোমবার সকালে চীনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে চার দিনের দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিংয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কেন চীন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “কূটনীতির অন্যতম লক্ষ্য ভারসাম্য রক্ষা করা। তবে সেটা নির্দিষ্ট কোনো ভারসাম্য নয়। অর্থ্যাৎ আমরা আমাদের বন্ধুদের সাথে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে সহযোগিতা বা প্রকল্পগুলো নির্ধারণ করব।”
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্পূর্ণ উল্লেখ করে এই কূটনীতিক বলেন, “ভারতের সাথে ইতিহাসের পাশাপাশি অবস্থানগত কারণে আমরা পরস্পর পরস্পরের ওপরে গভীরভাবে নির্ভরশীল। তার মানে এই না তারা আমাদের সব প্রয়োজন মেটাচ্ছে। অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো নিয়ে টানাপোড়নও হয়…”
“আবার আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থানকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। চীন আমাদের যতটুকু সাহায্য করতে পারে বা যতটুকু প্রয়োজন মেটাতে পারে এককভাবে অন্যকোনো দেশ সেটা পারছে না।”
“যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো সাহায্য নিতে চাই, তাতে যে খরচ পড়বে সেই খরচ বহন করার শক্তি আমাদের নেই। সুতরাং আমাদের সামর্থ্য এবং প্রয়োজনের সাথে মিলিয়ে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সহযোগিতা চীনের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি,” বলেন মুন্সি ফয়েজ।
তবে ঋণ নিলেও তা শোধ করার মতো বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা রাখার কথা বলেন তিনি। যাতে পরে আমরা বিপদে না পড়ি।
বাধা হবে না তিস্তা প্রকল্প
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়ে রাখলেও বাংলাদেশ এখন ভারতের প্রস্তাব নিয়েই ভাবছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, “তিস্তা ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী। এই যৌথ নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারত একটি প্রস্তাব দিয়েছে এবং একইসাথে ভারত একটি কারিগরি দল পাঠাবে বলে আমাদের জানিয়েছে। যেহেতু যৌথ নদী, আমাদের তো প্রথমে সেই প্রস্তাবটা বিবেচনা করতে হবে স্বাভাবিকভাবেই।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিষয়ে পরিস্কার হতে চাইবে চীন। তবে কাজটি না পেলেও দুই দেশের সম্পর্কে তা কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, “চীন এতোদিনে বুঝে গেছে যে, এককভাবে তিস্তা মহাপ্রকল্পের কাজ পাওয়া তাদের জন্য কঠিন। বাংলাদেশ চীনকে না দিলেও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পিছ পা হবে না দেশটি। তবে এই প্রকল্পের বিষয়টি স্পষ্ট হতে চাইবে বেইজিং। কারণ, এই প্রস্তাব বাংলাদেশই তাদেরকে দিয়েছিল। আর তাতে সম্মত হয়েছিল চীন।”
কাজটি না পেলে যতটুকু মনোক্ষুন্ন চীন হবে, সেটা অন্য দিকে থেকে পুষিয়ে নিতে চাইবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রতিশ্রুতি দিয়েও বছরের পর বছর ধরে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে সমাধান দিতে পারেনি ভারত। এমন পরস্থিতিতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৈরি তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা মহাপ্রকল্পের প্রস্তাবে ৮ হাজার ২শ কোটি টাকা ঋণ দিতে সম্মতি জানায় চীন।
এই প্রকল্পের আওতায় কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে পানি ধরে রেখে সারাবছর সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। ১১৫ কিলোমিটার নদীর পুরো অববাহিকা গভীর খনন ও দুই পাড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করাসহ নানা ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয় এই প্রস্তাবে।
কিন্তু প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এলাকার অদূরেই ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর থাকায় নিরাপত্তাজনিত কারণে তিস্তা প্রকল্পে চীনের অর্থায়নে আপত্তি জানিয়ে আসছিল ভারত। তবে সম্প্রতি এই প্রকল্পে নিজেই যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে নয়াদিল্লী। এ বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য একটি কারিগরি দল শিগগির ঢাকা সফর করবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে এ বিষয়ে একমত হয় দুই দেশ।
তৌহিদ হোসেন বলেন, “তিস্তা নিয়ে ভারতের আপত্তি মূলত নিরাপত্তাজনিত কারণে। ভারত-চীন মিলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে সেটা একটা মাইলফলক হবে। তবে তৃতীয় দেশে এমন ভারত ও চীন মিলে যৌথ প্রকল্প করার উদাহরণ নেই।”