শিশুর উন্নয়নে বাংলাদেশ আগের চেয়ে এগিয়েছে: সেভ দ্য চিলড্রেন
2018.06.01
ঢাকা
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিদের তুলনায় গত এক বছরে শিশু উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন।
১ জুন বিশ্ব শিশু দিবসকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার এই বিশ্ব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এতে বলা হয় শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশে।
প্রসঙ্গত, ইউনেস্কোর হিসেবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ঝরে পড়ার হার ক্রমাগত কমে এখন ৩৬ শতাংশ।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, অগ্রগতি হলেও শিশু সুরক্ষা নিয়ে এখনো অনেক দূর যেতে হবে বাংলাদেশকে।
সেভ দ্য চিলড্রেন প্রকাশিত ‘এন্ড অব চাইল্ডহুড’ র্যাংকিংয়ে এবার চার ধাপ অগ্রগতি করে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম। গত বছর অবস্থান ছিল ১৩৪তম।
গতবারের চেয়ে ২১ পয়েন্ট বেশি পেয়ে ৭০১ পয়েন্ট নিয়ে এ বছর পাকিস্তান (১৪৯) ও আফগানিস্তানের (১৬০) তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। তবে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে প্রতিবেশি ভারত (১১৩), শ্রীলংকা (৬০) ও মিয়ানমারের (১০৭) চেয়ে।
শিশু সুরক্ষায় রয়েছে বড়ো চ্যালেঞ্জ
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বেনারকে বলেন, “১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০। এতে আত্মতৃপ্তির কোনো অবকাশ নেই। আমরা শিশুদের সুরক্ষার ব্যাপারে এখনো অনেক দূরে অবস্থান করছি। এ বিষয়ে এখনো অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।”
শিশু অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ যতটুকু উন্নতি করেছে সেটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। তবে আমরা এখনও বেশ ঝুঁকির মধ্যে আছি।”
“শিশু কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার অন্যতম। ড্রপ আউট কমলেও তা যথেষ্ট নয়। ভাসমান শিশুদের কাজ নেই। যেসব শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কারখানায় কাজ করে তারা অত্যন্ত অমানবিক জীবন যাপন করছে। মেয়ে শিশুরাও নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে,” বলছিলেন ওয়াহিদা।
এবার সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে বহুমাত্রিক বঞ্চনা। বাল্য বিবাহ, কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ, শিশুমৃত্যু, শিশুশ্রম, অপুষ্টি, শিশুর প্রতি সহিংসতাসহ আটটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছে।
১৭৫ টি দেশের মধ্যে র্যাংকিংয়ে শীর্ষে রয়েছে যৌথভাবে সিঙ্গাপুর ও স্লোভেনিয়া। শীর্ষ পাঁচের অন্য দেশগুলি হচ্ছে নরওয়ে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। অনিরাপদ শৈশবের দিক দিয়ে শীর্ষ ১০টি দেশের ৮টিই পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার। নাইজারের শিশুদের শৈশব সবচেয়ে কষ্টকর বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা কর্মসূচির আওতাভুক্ত হোপ প্রকল্পের পরিচালক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, বেশ কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও এদেশের প্রান্তিক শিশুরা বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশুরা এখনও বিভিন্নভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
তিনি জানান, “বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে ২০ শতাংশেরও কম শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। এ ছাড়া স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে দৃশ্যমান প্রতিবন্ধিতা রয়েছে।”
তাঁর মতে, প্রতিবন্ধিতার শিকার শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো একান্ত জরুরি। পাশাপাশি একীভূত শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারের জন্য জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সংগঠনগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি।
সেভ দ্য চিলড্রেনের ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ও কোয়ালিটি) রিফাত বিন সাত্তার বলেন, “বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে বেশ ভালোই উন্নতি করেছে, বিশেষ করে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে। তবে শিক্ষায় অগ্রগতির সুফল সব শ্রেণির শিশুরা পাচ্ছে না। বিশেষ করে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবার ও প্রতিবন্ধিতার শিকার শিশুরা।”
“প্রতিবন্ধিতার শিকার প্রায় ৮০ ভাগ শিশুই স্কুলে যায় না, অথচ স্কুলে গেলেই তারা ভালো থাকত,” বলেন তিনি।
শিশু সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “শিশুদের স্কুলে আনার ব্যাপারে আমরা উন্নতি করেছি। কিন্তু সকল শিশু ধরে রাখার ব্যাপারে এখনো আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার পরে ১৪-১৫ শতাংশ শিশু ঝরে যাচ্ছে।”
“যারা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক সম্পন্ন করছে তারাও অপুষ্টিসহ নানা ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। মেয়েরা এখনো যৌনসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে শিশুরাও নানা নির্যাতনে ভোগে,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “এখনো শিশুর প্রতি সহিংসতার ব্যাপারে আইনি জটিলতা রয়ে গেছে। অনেক সময় আইন থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ নেই। রয়েছে সামাজিক বৈষম্য।”
শিশু সুরক্ষা নিশ্চিতে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও তদারকি জোরদার করা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই শিশু অধিকার কর্মী।
এদেশের দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী শিশুরা এখন পর্যন্ত নানা বৈষম্যের শিকার উল্লেখ করে ওয়াহিদা বানু বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য রোহিঙ্গারা একটি বড় সমস্যা।
“বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে, যার ৬০ ভাগ শিশু। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা এখন আমাদের শিশুদের পরিবর্তে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসছে। এটা আমাদের জন্য বড় ধাক্কা,” বলেন ওয়াহিদা বেগম।
অপুষ্টির শিকার এক তৃতীয়াংশের বেশি শিশু
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি শিশু যাদের বয়স ৫ বছরের কম তারা অপুষ্টিতে ভোগে, ৪৪ ভাগ কিশোরী মেয়েদের ২০ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায় এবং ৩.৫ ভাগ শিশু ৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায়।
শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে সরকারের ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন নামে ১০ বছর মেয়াদি পুষ্টি কার্যক্রম রয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয় এই কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।
গত ১১ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিউট্রিশন কাউন্সিলের মহাপরিচালক মো. শাহনেওয়াজ বলেন, “এই কার্যক্রমের মধ্যে খর্বাকৃতির বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। খর্বাকৃতির অন্যতম কারণ হলো অপর্যাপ্ত ব্রেস্ট ফিডিং, খাবারে পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দুর্বল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা।”
“সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে এ বিষয়টা এসেছে এবং এটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে, যা দেশের শিশু পরিস্থিতির উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে,” বলেন তিনি।