প্রধানমন্ত্রীর ‘একক ক্ষমতায়’ ভারসাম্য আনার প্রতিশ্রুতি দিলেন খালেদা জিয়া
2017.05.10
ঢাকা

বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোয় প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা দেশে ‘স্বৈরচারী একনায়কতান্ত্রিক’ শাসনের জন্ম দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই পরিস্থিতি অবসানে তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে সংবিধান সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের এই নেতা।
‘ভিশন ২০৩০’ নামে রূপকল্প প্রকাশ করে খালেদা জিয়া এই ঘোষণা দেন। গতকাল বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কিনা—এমন বিতর্কের মধ্যে এই রূপকল্প নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে আসলেন খালেদা।
বিশ্লেষকেরা তার ভিশন ২০৩০-কে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও একে মেধাহীন, অন্তঃসারশূন্য দাবি করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়ার রূপকল্প ঘোষণাকে শেখ হাসিনার অনুকরণ বলেও মনে করছেন তাঁরা।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে ২৩ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে ‘রূপকল্প-২০২১’ তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
খালেদার এই রূপকল্প প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “পুরো বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংগঠিত হবে। দুর্নীতির অবসান ঘটবে। শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।”
“তবে এগুলোর ফলাফল নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে শূন্যের কোঠায়,” মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বেনারকে বলেন, “খালেদা জিয়ার এই ভিশন ২০৩০ অন্তঃসারশূন্য, বিভ্রান্তিমূলক। উনি একদিকে ক্ষমতায় আসলে ’৭৪ সালের আইন বাতিল করার কথা বলেছেন। অথচ উনি একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সেই ক্ষমতার ভোগ এবং অপব্যবহার করেছেন। তখন কেন বাতিল করেননি?”
যা আছে খালেদার রূপকল্পে
২০০৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে সরকারের বাইরে থাকা বিএনপি ২০০৯ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সংসদেরও বাইরে চলে যায়। এবার ২০১৯ সালের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছরের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে ‘ভিশন ২০৩০’ এর রূপরেখা তুলে ধরার কথা জানান খালেদা জিয়া।
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দলের সেই প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন খালেদা। এ সময় তিনি বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন। বক্তৃতায় তিনি জনগণের হাতে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করে পদ্ধতিগত ও আইনের সংস্কারের পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পালের পদ সৃষ্ট করার কথা বলেন।
পাশাপাশি ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে জনপ্রশাসন, বিচার, পুলিশ, ও কারাগারকে স্বচ্ছ, দক্ষ, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার আশ্বাস দেন খালেদা জিয়া। সকল কালাকানুন বাতিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, ও খুনের অবসান ঘটানো এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ বাতিল করার ঘোষণাও দেন তিনি।
দেশের সংবিধানের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন খালেদা।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক বিধান’ যুক্ত করার সমালোচনা করে সেগুলো সংস্কার করার অঙ্গীকার করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
খালেদা জিয়া বলেন, “গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন শ্রেয় এই ধারণা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন সরকার। বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করবে।”
তিনি বলেন, “বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংবিধান সংশোধন করে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এবং জাতীয় সংসদকে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে জাতীয় সংসদে উচ্চ কক্ষ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।”
বিরোধী মতের নেতা কর্মীদের দমনে আদালতকে ব্যবহার করা হলেও ক্ষমতাসীনদের দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া।
সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি উল্লেখ করে খালেদা বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির মাধ্যমে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করার প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ধর্মের শিক্ষার প্রচার এবং শান্তি ও সম্প্রীতির চেতনাকে সুসংহত করার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাস দমনের একটি কর্মকৌশল প্রণয়ন করার কথা জানান।
দেশে সালিশী আদালত পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি পরীক্ষার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের অধীন পৃথক সচিবালয় করার প্রতিশ্রুতিও উঠে আসে খালেদার রূপকল্পে।
অন্তঃসারশূন্য ও জনবিচ্ছিন্ন: আওয়ামী লীগ
এদিকে বিএনপি নেতার রূপকল্প তুলে ধরার কিছুক্ষণের মধ্যেই বুধবার রাতে দলীয় সভাপতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এর প্রতিক্রিয়া জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বিএনপির ভিশন ২০৩০-কে মেধাহীন, অন্তঃসারশূন্য, দ্বিচারিতাপূর্ণ ও জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রলাপ বলে মন্তব্য করেন।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ‘ভিশন-২০২১’ উপস্থাপন করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের ভিশন চুরি করে খালেদা জিয়া জাতির সঙ্গে একটি তামাশা ও প্রতারণা করেছেন। এভাবে মেধাস্বত্ব চুরি করা একটি নৈতিক অপরাধ। এটা রাজনৈতিক অসততা।”
খালেদা জিয়া সংসদকে কার্যকর করার কথা বললেও বিরোধীদলীয় নেতা থাকতে মাত্র ১০ দিন তিনি সংসদে গিয়েছিলেন বলেও সমালোচনা করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী।
খালেদা জিয়া বরাবরের মতো এবারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন অভিযোগ তুলে ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপির ভিশন যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার, সন্ত্রাসবাদ কায়েম করা ও দেশ বিক্রির ভিশন।”