ইশতেহার প্রকাশ: ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা চাইলেন শেখ হাসিনা
2018.12.18
ঢাকা

গত ১০ বছরের শাসনামলে কোনো ভুল হয়ে থাকলে তা দেশবাসীকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর দলকে ভোট দিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন মহাজোটকে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ এবং সরকার বিরোধী প্রধান মোর্চা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল দল জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মঙ্গলবার একইদিনে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে।
একই দিন উচ্চ আদালত আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারবেন না বলে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে। দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তাঁর ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দুই দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার পরে দেশব্যাপী নির্বাচনী আমেজ চাঙা হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বেনারকে বলেন, “এর মাধ্যমে দুটি দলই নেতা-কর্মীদের হাতে প্রচারের চূড়ান্ত অস্ত্র তুলে দিয়েছে। সারা দেশে আজ থেকে নতুন উদ্যমে প্রচারণা শুরু হবে।”
“বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আমরা আশাতীতভাবে হলেও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। একটির পর একটি বক্সে টিক চিহ্ন দেওয়ার মতো করে এক একটি অধ্যায় পার করছে দলগুলো,” বলেন তিনি।
ক্ষমা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
রাজধানীর একটি হোটেলে দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণাকালে টানা প্রায় এক দশক যাবৎ সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা বলেন, “আমি নিজে এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।”
“কথা দিচ্ছি, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব। আপনারা নৌকায় ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করে দেবো—এটা আমাদের ওয়াদা,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে ইশতেহার ঘোষণার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বিগত ১০ বছরে দেশে ‘সুশাসন’ বা ‘আইনের শাসন’ ছিল না দাবি করে বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদার কারাবাস এবং দেশে ফিরতে পারছেন না ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান।”
ফখরুল বলেন, “একটি নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ লড়াই শুধু জয়-পরাজয়ের লড়াই নয়, অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুক্ত জীবনে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই।”
‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে ঘোষিত আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার করা হয়েছে; আর ‘এগিয়ে যাব এক সাথে, ভোট দেব ধানের শীষে’ শিরোনামে প্রকাশিত বিএনপির ইশতেহারে গুরুত্ব পেয়েছে ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি।
আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারের মধ্যে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল; সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা রয়েছে।
বিএনপির ইশতেহারে গুরুত্বারোপ করা ১৯ দফার মধ্যে রয়েছে; মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থনীতি, মুক্তিযোদ্ধা, যুব নারী ও শিশু, প্রতিরক্ষা ও পুলিশ, আবাসন-পেনশন ফান্ড ও রেশনিং ফান্ড প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ, পররাষ্ট্রের মতো বিষয়গুলো।
ইশতেহার ঘোষণাকালে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০০১-০৬ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদের উত্থান, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর গ্রেনেড হামলাসহ আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতা-কর্মী হত্যার অভিযোগ করেন।
বিপরীতে ফখরুল বলেন, “বিএনপি জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করতে চায়, ক্ষমতায় গেলে কারও ওপরই কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।”
তবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে দুই দলই। শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করব। সংসদকে আরও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
বিএনপির ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার দেওয়া, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকা, গণভোট পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষ সংসদ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়।
নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো প্রবর্তন, নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল ‘কালা কানুন’ (জনবিরোধী আইন) বাতিল করার কথা উল্লেখ রয়েছে বিএনপির ইশতেহারে।
দু’পক্ষই ভাবছে মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দাবি করা হয়েছে, তারা এসব মেগা প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে দৃঢ়সঙ্কল্প। অন্যদিকে বর্তমানে চলমান কোনো প্রকল্প বন্ধ না করার কথা বলা হয়েছে বিএনপির ইশতেহারে।
তবে দলটি বলেছে, মেগা প্রকল্পের ব্যয়ের আড়ালে সংঘটিত দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। সরকারের শেষ দুই বছরে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করে দেখা হবে বলেও জানিয়েছে তারা।
উল্লেখ্য, চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মাস-র্যাপিড ট্রানজিট (মেট্রোরেল) প্রকল্প অন্যতম।
কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দুই দলের
শেখ হাসিনা বলেন, “নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে আমরা আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। প্রতি উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে এক হাজার যুবক বা যুব মহিলার বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।”
চরম দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজনের নিয়মিত রোজগার নিশ্চিত করা হবে।”
অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, প্রথম তিন বছরে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দুই লাখ মানুষকে চাকরি দেওয়া হবে। আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। তরুণ দম্পতি ও উদ্যোক্তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ২০ বছর মেয়াদি ঋণ চালু করা হবে।
সংখ্যালঘু কমিশন-মন্ত্রণালয়ের প্রতিশ্রুতি
আওয়ামী লীগ বলেছে, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও ব্যবস্থার অবসান করা হবে। তবে কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করা হবে না।
অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, দল, মত, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতি গোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকর্মের অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এই লক্ষ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দুই দল।
প্রার্থিতা ফিরল না খালেদা জিয়ার
এদিকে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন আসনে প্রার্থিতা ফিরে পেতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার করা রিট আবেদন মঙ্গলবার খারিজ করেছে বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের একক বেঞ্চ।
ফলে আসন্ন নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকল না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
খালেদার আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল বেনারকে জানান, “এরপর কী করা হবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।