বেইলি রোডের বহুতল ভবনটিতে ছিল না অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, মৃত্যু বেড়ে ৪৬

জেসমিন পাপড়ি
2024.03.01
ঢাকা
বেইলি রোডের বহুতল ভবনটিতে ছিল না অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, মৃত্যু বেড়ে ৪৬ ঢাকার বেইলি রোডে আগুনে পোড়া গ্রিন কোজি কটেজ ভবন দেখতে ভবনটির সামনে জনতার ভিড়। বৃহস্পতিবার এই ভবনে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন অনেকে। ১ মার্চ ২০২৪।
[সুদীপ্ত সালাম/বেনারনিউজ]

ঢাকার বেইলি রোডে যে ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে কোনো অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফায়ার সার্ভিস এর আগে তিনবার নোটিশ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি ভবন মালিক।

শুক্রবার দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রিন কোজি কটেজ নামের এই ভবনটি পরিদর্শনের পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ কথা জানান।

মাইন উদ্দিন বলেন, “ভবনটিতে কোনো অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। লোকজনের ব্যবহারের জন্য কেবলমাত্র একটি ছোট সিঁড়ি ছিল। এই ভবনের একটি ফ্লোর ছাড়া প্রায় প্রতিটিতে খাবারে দোকান থাকায় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে।”

বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে বেইলি রোডের আটতলা গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এই দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই জন ভর্তি আছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্তলাল সেন জানিয়েছেন, বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন প্রায় সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের পাশাপাশি ভবনটিতে অনিয়মের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস।

এই ঘটনা প্রসঙ্গে ভবন মালিকরা রাজউকের নিয়ম মানতে চান না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি তলায় গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে অবরুদ্ধ একটি সরু সিঁড়ি দিয়ে লোকেরা কীভাবে চলাচল করবে!

“মালিকরা রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) নিয়ম মানতে চায় না। সবাই নিয়ম লঙ্ঘন করতে চায়, এটাই সমস্যা," যোগ করেন তিনি। 

image_6483441.JPG
বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন লেগে নিহত একজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়া এক আত্মীয়। ১ মার্চ ২০২৪। [জীবন আহমেদ/বেনারনিউজ]

এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ অফিসসহ বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থার অবহেলার কারণে ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাঁদের মতে, এটি এক ধরনের হত্যাকাণ্ড।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বেনারকে বলেন, “আমি অগ্নিকাণ্ডের শিকার ভবনটি পরিদর্শন করে দেখেছি যে, পুরো বিল্ডিংয়ে একটিও ভেন্টিলেটর নেই। পুরো ভবনটি কাচে ঢাকা ছিল।”

তিনি বলেন, সরকারের প্রায় আটটি সংস্থার অনুমোদন নিয়ে এই ধরনের ভবনে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়। এই প্রতিটি সংস্থা এখানে দায়ী। তাদের অবহেলা এতটাই ভয়াবহ যে, আইনের ব্যত্যয় করে ভবনটির প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে ফায়ার স্কেইপ, মূল সিঁড়ি অত্যন্ত সরু করে রাখা হয়েছে। পুরো ভবনটি ছিল আবদ্ধ, নরমাল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই। মানুষগুলো দম বন্ধ হয়ে, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।

“আমি দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষ পরিদর্শন করেছি, যেখানে নয় জন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ঘরের দেয়ালে আঁচড়ের দাগ ছিল; এর মানে তাঁরা তাঁদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন,” বলেন তিনি।

প্রায় সব ফ্লোরে গ্যাস সিলিন্ডার ছিল উল্লেখ করে হাবিব বলেন, ভবনটি মূলত অফিস ও আবাসনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না রেখে এটি বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত করা হয়।

তিনি বলেন, “সরকারি আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স পেতে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া পূর্বশর্ত। রাজউকের নকশা অনুমোদন এবং ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ ফায়ার ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিতে পারে না। উল্লিখিত সার্টিফিকেট ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর অবশ্যই ছাড়পত্র ইস্যু করবে না।

“ভবনটি বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে; তাদের সহযোগিতা ছাড়া ভবনের এই পরিবর্তন করা অসম্ভব ছিল। তাই ভবনটির সঙ্গে জড়িত সব সংস্থাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো দরকার। এত মানুষের মৃত্যুর দায় এসব সরকারি সংস্থাকে নিতে হবে,” বলেন হাবিব।

তিনি আরও বলেন, “এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।"

আগুনের পুড়ে যাওয়া ছাড়াও বিষাক্ত কালো ধোঁয়া এত মানুষের মৃত্যুর কারণ বলে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসকরা।

শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, “যারা মারা গেছেন, তাঁরা কার্বন মনোঅক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ, একটি বদ্ধ ঘরে ধোঁয়া যখন বের হতে পারে না, তখন শ্বাসনালীতে চলে যায়। প্রত্যেকেরই তাই হয়েছে। যাদের বেশি হয়েছে, তারা মারা গেছেন। তবে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তারাও কেউ শঙ্কামুক্ত নন।”

অগ্নি নির্গমন পথ না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ

সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, রাজধানীর বেইলি রোডের বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নি নির্গমন পথ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আমরা অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছি, তবুও মানুষ এতটা সচেতন নয়। আপনি একটি বহুতল ভবনে আগুন দেখেছেন, যার কোনো অগ্নি নির্গমন পথ ব্যবস্থা নেই।”

শেখ হাসিনা শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ভবন বা স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে তিনি সব সময় স্থাপত্যবিদদের অনুরোধ করেন যেন ভেন্টিলেশন এবং অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু স্থাপত্যবিদরা সেভাবে নকশা করেন না, আবার মালিকরা এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়তে চান না।

“আমরা ফায়ার এক্সটিংগুইসার লাগানোসহ অগ্নি নির্বাপণ পথের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ বারবার দিচ্ছি, সেটা কিন্তু তারা মানে না,” বলেন তিনি।

তদন্ত কমিটি

ভবনের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কোনো বিচ্যুতি হয়েছে কি না—তা খতিয়ে দেখতে বৃহস্পতিবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রাজউক।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকলে তদন্ত কমিটি দায়ী ব্যক্তিদেরও খুঁজে বের করবে।”

তিনি বলেন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার দায়িত্বে থাকা রাজউকের সদস্য আবদুল আহাদ সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান হবেন, যাকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে ফলাফল জমা দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে বেইলি রোডের ওই ভবনে পরিচালিত দুটি প্রতিষ্ঠানের তিন জনকে শুক্রবার আটক করেছে পুলিশ।

এদিন সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন জানান, ‘চুমুক’ খাবারের দোকানের দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান এবং আরেকটি খাবারের দোকান ‘কাচ্চি ভাই’ এর ব্যবস্থাপক জয়নুদ্দিন জিসানকে আটক করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।