‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি সাইফুল
2019.05.31
ঢাকা ও কক্সবাজার

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ইয়াবা চোরাকারবারিদের তালিকার দুই নম্বরে থাকা সাইফুল করিম (৪০) পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। সরকারের কাছ থেকে সেরা করদাতা হিসেবে তিনবার সিআইপি মর্যাদা পাওয়া এই ব্যক্তি মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর দুবাই পালিয়ে যান।
পুলিশ সাইফুলকে নিয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ইয়াবা উদ্ধার অভিযানে যাওয়ার কথা বললেও তিনি কবে দেশে ফেরেন এবং কখন, কীভাবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় তা কিছুটা রহস্যাবৃত।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাস বেনারকে জানান, মিয়ানমার থেকে টেকনাফে আসা ইয়াবার একটি বড় চালান ধরতে গেলে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে বারোটায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাইফুল নিহত হন।
এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, সাইফুলকে বৃহস্পতিবার রাতেই টেকনাফের স্থলবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
“গ্রেপ্তারের পর সাইফুল জানায়, কয়েকদিন আগে মিয়ানমার থেকে একটি ইয়াবার বড় চালান এনে স্থল বন্দর সংলগ্ন নাফ নদীর কিনারায় মজুত রাখা হয়েছে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ তাকে নিয়ে ইয়াবা উদ্ধারে সেখানে অভিযান চালায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে তার সহযোগীদের গোলাগুলির ঘটনায় সাইফুল আহত হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে,” জানান ওসি।
তবে মানবাধিকার কর্মী নূর খান বেনারকে বলেন, “ঘটনার বর্ণনা রহস্যজনক। আমার ধারণা সাইফুল পুলিশের কাছে বেশ আগেই ধরা দিয়েছিল। কিছুদিন ধরে দুবাই থেকে সে ফেসবুকে কান্নাকাটি করে পোস্ট দিচ্ছিল। ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত থাকার কারণে মানুষের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল, বলছিল সে ভালো হয়ে যাবে।”
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার দৈনিক প্রথম আলোতে ‘ইয়াবার মূল হোতা সাইফুল আত্মসমর্পণ করতে চান’ শীরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে পুলিশে সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, সাইফুল পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাইফুলের নিহত হওয়ার সংবাদ জানায় পুলিশ।
“হয়ত কেউ তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে দেশে ফিরে আসলে তার কিছু হবে না। আত্নসমর্পণ করে ভালো হওয়া যাবে। আর সে কারণেই সে দেশে ফিরেছিল,” বলেন নূর খান।
তাঁর মতে, “ক্রসফায়ারের নামে হত্যার কারণ হচ্ছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক রাঘব বোয়ালের নাম বেরিয়ে আসবে। আর এ কারণে তাকে এভাবে বিচারের মুখোমুখি না করে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।”
এদিকে বিজিবির সাথে পৃথক দুটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ টেকনাফে মোহাম্মদ ইউনুছ (৩৫) এবং দিনাজপুরে মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৫) নামে দুই ‘মাদক চোরাকারবারি’ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার ভোর রাতের মধ্যে মারা গেছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কে এই সাইফুল?
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন লোকালয়ে ব্যবহৃত মাদকের শতকরা ৯৪ ভাগের বেশি ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
ইয়াবার চালান বন্ধ করতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মোট ১ হাজার ২৫০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর এই তালিকার এক নম্বরে রয়েছে টেকনাফ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদি আর দুই নম্বরে সাইফুল করিমের নাম।
তালিকাভুক্তদের ৯১২ জনের বাড়ি কক্সবাজার জেলার টেকনাফে। সাইফুল করিমের বাড়ি টেকনাফের সিলবনিয়াপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম ডা. মোহাম্মদ হানিফ।
পুলিশসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ইয়াবা ব্যবসা করে রাতারাতি ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন সাইফুল করিম। কক্সবাজার জেলা থেকে সর্বোচ্চ কর দিয়ে তিনি তিনবার সেরা করদাতা হিসেবে সিআইপি মর্যাদাও লাভ করেন।
২০০৩ সালের দিকে সাইফুল টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন।
গত বছরের ৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর এলাকায় একটি চালানে ১৩ লাখ ইয়াবা বড়ি আটক হওয়ার পর সাইফুল করিমের নাম আলোচনায় আসে। এর পরপরই তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি দুবাইতে ছিলেন।
টেকনাফে সর্বাধিক নিহত
গত বছরের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলমান এই অভিযানে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা সাড়ে তিন শতাধিক।
অভিযানে বেশি নিহত হয়েছে কক্সবাজার জেলায়, ১০৬ জন। এর মধ্যে নারীসহ ২১ রোহিঙ্গা রয়েছে। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় নিহতের সংখ্যা দেশের যে কোনো এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি, সর্বোচ্চ ৬৫।
ওসি প্রদীপ কুমার বলেন, “টেকনাফ সীমান্ত ইয়াবা প্রবেশের মূল পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত। ফলে এখানে মাদক বিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বেশি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আত্মরক্ষার্থে ছোঁড়া গুলিতে মাদক কারবারীরা নিহত হচ্ছে।”
ক্রসফায়ারে ইয়াবা বন্ধ হবে কি?
মানবাধিকার কর্মীরা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাগুলোকে ‘হত্যাকাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এভাবে মাদক বন্ধ করা যাবে না। তাঁরা প্রচলিত আইনে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে আসছেন।
সাইফুল হত্যাকে গাছ রেখে গাছের একটি ডাল কাটার সঙ্গে তুলনা করে নূর খান বলেন, ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করতে হলে মূল সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দায়ী সকলকে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।
তিনি বলেন, “এর আগে মাদক ব্যবসায়ী হিসাবে চিহ্নিত করে একরামকে হত্যা করা হয়। অথচ একরাম মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন না। তার হত্যাকাণ্ড জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, অভিযানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে, ক্রসফায়ারের নামে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।”
তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বেনারকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনো হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে না। তাঁর দাবি, মাদক বিরোধী অভিযান চলমান থাকায় ইয়াবার প্রকোপ কমেছে। তবে, এটা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।”
তিনি বলেন, “মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সচেতনতা। সে কারণে সারাদেশে মাদক বিরোধী প্রচারণা চলছে।”
মহাপরিচালক বলেন, “আমরা আইনি প্রক্রিয়াও চালু রেখেছি। দেশের মোট কারাবন্দির শতকরা ৩৫ ভাগ মাদক মামলার আসামি। তারা সহজে জামিন পাচ্ছে না।”
এদিকে দেশের বিভিন্ন জেলে মাদক মামলার আসামির সংখ্যা ২৪ হাজারের বেশি বলে বেনারকে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “আমাদের সরকার মাদকের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এটি বন্ধ হবে না। আমরা জঙ্গিদের যেভাবে দমন করেছি একইভাবে মাদক চোরাকারবারীদের দমন করব।”
মন্ত্রী বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায়। এ সময় তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি করলে কেউ কেউ মারা যায়। নির্দোষ কেউ মারা যাচ্ছে না।”