পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি,অর্ধ শতাধিক বাংলাদেশির নাম
2016.05.10
পানামা পেপারস ও অফশোর লিকস মিলিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্ধ শতাধিক বিত্তবান ও ব্যবসায়ীর নাম এসেছে, যে তালিকা আরও লম্বা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বহুল আলোচিত পানামা পেপারসের দ্বিতীয় কিস্তিতে বাংলাদেশের অন্তত ১৮ জনের নাম গত সোমবার প্রকাশ হয়।দি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) বিশ্বের ২১টি অঞ্চলের তিন লাখের বেশি অফশোর কোম্পানির তথ্যের যে ডেটা বেজ প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের এসব ব্যক্তির নাম রয়েছে।
নতুন তালিকায় যেসব বাংলাদেশির নাম এসেছে সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অন্যদিকে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ—টিআইবি বলেছে, এই টাকা উদ্ধারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সদিচ্ছা ও সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
“অর্থ পাচার রোধ করা, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা ও সংশ্লিষ্টদের বিচারের মুখোমুখি করা জটিল কাজ। তবে তা মোটেও অসম্ভব নয়,” গতকাল সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায় টিআইবি।
পানামা পেপারসে বাংলাদেশের যারা
পানামা পেপারসের তালিকায় যে ১৮ জনের নাম এসেছে, তাদের কারও কারও নাম অফশোর লিকসেও ছিল। এবারের তালিকায় আছেন সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহবুব চৌধুরী, তালিকার মধ্যে তিনি আলোচিত ও পরিচিত মুখ। মেহবুব আগে গ্রামীণফোনের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ছিলেন।
ওই তালিকায় রয়েছে আইজিডাব্লিউ অপারেটর সেল টেলিকমের কফিল এইচ এস মুয়ীদ, এক্সেসটেলের মালিক জাইন ওমর, কিউবির অংশীদার আফজালুর রহমান।
মেহবুব ও মুয়ীদ কোপার্নিকাস ইনভেস্টমেট লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার। এই ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার জন্য মেহবুব চীনা এবং মুয়ীদ উরুগুয়ের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন।
কোপার্নিকাস ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড আবার মোসাক ফনসেকার সিঙ্গাপুর শাখার একটি ইন্টারমেডিয়ারি কোম্পানি। অর্থাৎ, মোসাক ফনসেকা কার হয়ে ওই কোম্পানি খুলেছে, এই নথি থেকে তা জানা যায়নি।
এই তালিকা প্রকাশের পর দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “তালিকায় থাকা একজন হলেন বেনজির আহমেদ। বাংলাদেশে এই নামে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রয়েছেন।এগুলো যাচাই–বাছাই করতে সময় লাগবে।”
মো. মোতাজ্জারুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির নাম তালিকায় থাকলেও তিনি একজন ঠিকাদার। কেবল স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদারি করে মোতাজ্জারুল ইসলাম ওরফে মিঠু কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হন।
তথ্য ভান্ডার থেকে বাংলাদেশের আরও যাদের নাম জানা গেছে, তাদের অধিকাংশেরই পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তালিকায় মল্লিক সুধীর, মো. ইউসুফ রায়হান রেজা, ইসরাক আহমেদ, নভেরা চৌধুরী, বিলকিস ফাতিমা, ফরহাদ গনি মোহাম্মদ, মো. আবুল বাশার, নিজাম এম সেলিম, মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম, সরকার জীবন কুমার ও মো. সেলিমুজ্জামানের নাম রয়েছে।
এর বাইরে রজার বার্ব, ‘দি বিয়ারার’, পেসিনা স্টেফানো, রুডি বেন-জামিন নাম ব্যবহার করে শেল কোম্পানিতে যুক্ত হওয়া অন্তত চারজনের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ পেয়েছে আইসিআইজে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্তত ১৪টি ঠিকানা এসেছে পানামা পেপারসে যেগুলো ব্যবহার করে বিদেশি ব্যক্তিদের নামে অফশোর কোম্পানির শেয়ার কেনা হয়েছে।
অফশোর লিকসে আরও যারা
আইসিআইজের আগের প্রকাশিত অফশোর লিকস ডেটা বেজে বাংলাদেশিদের তালিকায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাফর উল্যাহ ও নীলুফারের নাম রয়েছে।
জাফর উল্যাহ ও নীলুফারকে ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডে নিবন্ধিত পাথফাইন্ডার ফিন্যান্স এবং হ্যানসিটিক লিমিটেডের পরিচালক বা অংশীদার হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ওই তালিকায় রয়েছে বাংলা ট্র্যাকের মালিক আমিনুল হক, তার ছেলে নাজিম আসাদুল হক ও তারিক একরামুল হকের নাম। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানের স্ত্রীর ভাই ও ব্যবসায়ী আজমাত মঈনও এর মধ্যে রয়েছেন।
অফশোর লিকসের তথ্য ভান্ডারে বাংলাদেশের আরও যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন; দিলীপ কুমার মোদি, কাজী রায়হান জাফর, মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দা সামিনা মির্জা, উম্মে রুবানা, সালমা হক, আসমা মোনেম, এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম, সৈয়দ সেরাজুল হক ও এফ এম জুবাইদুল হক।
বাংলাদেশের তিনটি বড় কোম্পানি সামিট, ওয়েস্টার্ন মেরিন ও আবদুল মোমিন লিমিটেডের নাম রয়েছে অফসোর কোম্পানির নামের তালিকায়।
তদন্ত করবে দুদক
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির নতুন তালিকায় যেসব বাংলাদেশির নাম এসেছে সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত ৭ এপ্রিল দুদকের উপপরিচালক আখতার হামিদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করে দুদক। ওই দলটি ১১জনকে তলবি নোটিশ পাঠায়। এর মধ্যে দুজনকে তাঁদের ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। ছয়জনকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছেন। বাকিরা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সময় নিয়েছেন বলে সচিব জানান।
“তদন্তাধীন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া সংস্থার চেয়ারম্যান বিদেশে থাকায় নতুন তালিকা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুদিন দেরি হবে,” বেনারকে জানান দুদকের সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল।
ফেরত আনার উদ্যোগ নেই
দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই । ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে অর্থ পাচারের হার।
“সরকারের উচিত অর্থ পাচারকারী বা কর ফাঁকির প্রক্রিয়ায় জড়িতদের সম্পর্কে তথ্য নিয়ে তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিচারের আওতায় আনা। সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করলে সেটা সম্ভব,” বেনারকে জানান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, অর্থ পাচারের বৈশ্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্টরাই অর্থ পাচার করে বা কর ফাঁকি দেয়। এর সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া।