বিচারকদের অপসারণে নতুন আইন করছে সরকার
2016.04.25

স্বাধীনতার পর এই প্রথম বিচারকদের অপসারণে আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যা নিয়ে কিছুটা ভিন্নমত সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারকদের মতামত ছাড়াই মন্ত্রিসভা এ–সংক্রান্ত আইনটির খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে।
আগামী ৫ মে এ–সংক্রান্ত একটি রিট মামলার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। তাঁর আগে মন্ত্রিসভায় আইনটি অনুমোদন করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভা বিচারকদের অসদাচরণ সম্পর্কিত আইনটির খসড়া নীতিগত অনুমোদন করে, যেটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার মন্ত্রিসভায় উঠবে।
সুপ্রিম কোর্টের অভিযুক্ত বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থ্য-সম্পর্কিত আইনটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন, ২০১৬’। আগে এটির নাম ছিল ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্য (তদন্ত ও প্রমাণ) আইন, ২০১৬’।
নতুন আইনে অভিযুক্ত বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবেন এবং হয়রানির শিকার হলে প্রতিকার পাবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচিত এই আইনটির অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে আইনটি এই মুহূর্তে করা জরুরি কিনা, আইনটি সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির মত না দেওয়া, ৫ মে এ-সংক্রান্ত মামলার রায় দেখে আইনটি করা উচিত কিনা—এসব বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার আলোচনা শোনার পর বলেন, আইনটি বিচারকদের জন্য শোভনীয় হবে। তা ছাড়া অভিযুক্তের বিচার হবে কয়েকটি ধাপ পার হয়ে, যা আগে ছিল না।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, এটি ভারসাম্যপূর্ণ একটি আইন। এতে বিচারকদের অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা সুরক্ষিত হবে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে দাখিল করতে হবে। ১০ জন সাংসদকে নিয়ে স্পিকার একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে অভিযোগের সত্যতা নিরূপণ করবেন।
প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে স্পিকার বিষয়টি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির কাছে পাঠাবেন।
তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতি। এ ছাড়া ওই কমিটিতে সাবেক একজন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিককে রাখার কথা বলা হয়।
তদন্ত-প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত ফলাফল জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে হবে। এরপর সংবিধানের ৯৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারককে অপসারণ-সংক্রান্ত প্রস্তাব জাতীয় সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গ্রহণ করতে হবে। এরপর রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে অপসারণ করবেন।
কেউ ভিত্তিহীন ও হয়রানিমূলক অভিযোগ করলে দুই বছর এবং অনূর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
পাকিস্তান ছাড়া পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে, এমনকি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে এ ধরনের আইনের মাধ্যমে বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও বিচার হয়ে থাকে।
এই আইনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অসম্মানজনক বিদায় বন্ধ হবে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল মন্ত্রিসভা আইনটির খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার পর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।
ওই খসড়া তৈরির পর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কাছে মতামত চেয়ে না পাওয়ার কথাও এসময় সাংবাদিকদের জানান আনিসুল হক।হাই কোর্টে এই বিষয়ে মামলা থাকায় তাঁরা অভিমত দেননি বলে জানান তিনি।
আইনমন্ত্রী বলেন, “অপসারণের প্রক্রিয়া আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হবে—এটা ১৯৭২ সালের সংবিধানে লেখা ছিল। ১৯৭২ থেকে শুরু করে ১৯৭৭ পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো আইন হয়নি। তারপর এটাকে বিলুপ্ত করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করা হয়।”
তিনি বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিল সংসদে পাস হয়। এর বিরুদ্ধে রিট আবেদন হয়।
আইনজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ১৯৭২ সালের গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত ও পাসকৃত মূল সংবিধানের কোনো বিধান চ্যালেঞ্জ করা যায় না। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রবর্তন হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে রিট চলে না।
“৯৬ অনুচ্ছেদ পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংযুক্ত করতে পারলে ভালো হতো। যে কোনোভাবে বাদ পড়ায় দেশের স্বার্থে এটা ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছে। এর ফলে সংসদ বিচারকদের অসদাচরণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে,” বেনারকে জানান সংবিধান সংশোধন কমিটির কো চেয়ারম্যান ও সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের নিয়মটি সংবিধানে এ পর্যন্ত তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৯৬ (২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। আর আইন-সংক্রান্ত ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়।
১৯৭৭ সালে বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিতে আবার পরিবর্তন আসে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের হাতে ফিরে যায়।
“এ –সংক্রান্ত একটি মামলার রায় যেহেতু ৫ মে ঘোষণা হতে পারে, সেহেতু একটু দেরি করা যেত। যেহেতু এত দিন দেরি হয়েছে, সেহেতু ১০–১২ দিনে এমন কোনো ক্ষতি হতো না,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।