১১ নারী হত্যাকারী ‘সিরিয়াল কিলার’কে মৃত্যুদন্ড দিল বাংলাদেশের আদালত

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.04.22
BD-killer ‘আত্মস্বীকৃত সিরিয়াল কিলার’ রসু খাঁর ফাঁসির রায়ের পর পুলিশ তাকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে। ২২ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

এক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে ‘আত্মস্বীকৃত সিরিয়াল কিলার’ রসু খাঁর ফাঁসির রায় দিয়েছে বাংলাদেশের একটি আদালত। ১১ নারীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত রসুর বিরুদ্ধে এটা প্রথম রায়।

চাঁদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইন্যুবালের বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুনাভ চক্রবর্তী বুধবার সাত বছর আগের এ ঘটনার রায় ঘোষণা করেন। এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাদী পক্ষ। তবে আসামি পক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করবে বলে জানিয়েছে।

রায়ের সময় আসামি রসু খাঁ কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। বিচার চলাকালে ১১ নারীকে হত্যার কথা স্বীকার করেন তিনি। চাঁদপুরের মদনা গ্রামের ছিঁচকে চোর রসু একসময় সিরিয়াল কিলারে পরিণত হন। ১০১টি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর লক্ষ্য ছিল বলে পুলিশকে জানান তিনি।

২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর মসজিদের মাইক চুরির মামলায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন রসু খাঁ। এরপরই তার লোমহর্ষক সব হত্যাকাণ্ড জানাজানি হয়।
রায়ে একটি ধারায় আসামি রসুকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিচারক। এছাড়া অন্য একটি ধারায় তাকে ৮ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এদিকে এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নারী নেত্রীরাও। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বেনার নিউজকে বলেন, আপিল বিভাগের রায় চূড়ান্ত না হওয়া পর‌্যন্ত আসামির বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে বলা যাবে না। তবে বিচারিক আদালত যে রায় দিয়েছেন তা নারী নির‌্যাতনের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।


যেভাবে ফাঁস হয় রসুর নৃসংশতা

মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০০৮ সালের ১৮ অগাস্ট ফরিদগঞ্জের নানুপুর খালপাড়ে খুলনার দৌলতপুরের সজলা গ্রামের সাহিদা বেগমকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন রসু খাঁ। পরে পুলিশ সাহিদার হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে।

সে সময়ে চাঁদপুর মডেল থানার তৎকালীন এসআই নজরুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয় আসামির বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তদন্তে কোনো তথ্য না পেয়ে একসময় মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

এরমধ্যে ২০০৯ সালের ২০ জুলাই টঙ্গীর নিরাশপাড়া মসজিদের ফ্যান চুরির একটি মামলায় রসু খাঁকে গ্রেপ্তার করে ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ। এরপরই পুলিশের কাছে একের পর এক এসব হত্যা মামলার রহস্যজট খুলতে থাকে। শেষমেষ রসুর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ১১ নারীকে হত্যার অভিযোগ। রসু সাহিদাকে হত্যার কথা স্বীকারের পর ২০১০ সালে মামলাটিও পুনরায় চালু করা হয়।

রসু চাঁদপুরের বিচারিক হাকিম আমিরুল ইসলামের কাছে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ১১ খুনের বর্ণনা দেন।

১০১ জন নারীকে খুন করে সিলেটের মাজারে গিয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছার কথাও জানান রসু খাঁ।
জানা যায়, রসু হত্যার জন্য নারী পোশাককর্মীদেরকে বেছে নিতেন। ভালোবাসার অভিনয় করে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ঢাকার সাভার ও টঙ্গী এলাকা থেকে চাঁদপুরে নিয়ে যেতেন তিনি। সেখানে ধর্ষণের পর হত্যা করতেন তাদের। হত্যার শিকার এসব হতভাগ্য মেয়ের অধিকাংশেরই সঠিক নাম-ঠিকানা বা পরিচয় আজও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

রসু খাঁর বিরুদ্ধে   চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ থানায় মোট ১০টি মামলা করা হয়। এর ভেতর নয়টি হত্যা এবং অপরটি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে।  এসব মামলার বিচারের জন্য একসময় চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হলে সেখানে একটি মামলার রায়ে তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। এরপর বাকি মামলাগুলো চাঁদপুর আদালতে পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মুহূর্তে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি ও অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে আটটি মামলার বিচার চলছে।

বতর্মানে রসু খাঁকে চাঁদপুর জেলা কারাগারে রাখা রয়েছে। আদালতে রসুকে বেশ স্বাভাবিক দেখা যায়। এমনকি রায়ের পর কারাগারে নেওয়ার সময় পুলিশ হেফাজতেই আয়েশ করে সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি।

আদালতের সরকারী কৌঁসুলি সায়েদুল ইসলাম টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “দেরিতে হলেও সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ’র উপযুক্ত সাজা হয়েছে। হত্যার শিকার নারীরা ন্যায় বিচার পেয়েছেন।”
তবে আসামির আইনজীবী নইমুল ইসলাম বলেন,“এটি চূড়ান্ত রায় নয়। আমরা আপিল করব। মহামান্য হাই কোর্টই নির্ধারণ করবে আসামি ন্যায় বিচার পেয়েছে কিনা।”

তবে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন অনেকে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, সাত বছর দীর্ঘ সময়। এ ধরনের স্পর্শকাতর মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা উচিত।
তবে দেরিতে হলেও নারী নির্যাতনের মামলায় এ ধরনের শাস্তিমূলক রায় আইনের শাসনের জন্য ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন তিনি।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।