বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কূটনৈতিক যুদ্ধ, ঢাকার কড়া প্রতিবাদ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.02.02
BD-diplomacy মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কটাক্ষ ও পাকিস্তানী কূটনীতিকের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদির প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের মশাল মিছিল।
বেনার নিউজ

আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক। পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক প্রত্যাহারের পর দুদেশে এবার পাল্টা-পাল্টি হাইকমিশনের কর্মী ‘নিখোঁজের’ ঘটনা ঘটলো। একটার পর একটা তিক্ত ঘটনা ঘটলেও এখনই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছ্ন্নি করার বিষয়ে  ভাবছে না কোন পক্ষই।

‘সন্দেহজনক গতিবিধি’র কারণে সোমবার বাংলাদেশের পুলিশ ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের এক কর্মীকে আটক করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা নিখোঁজের খবর পাওয়া যায়। পরে প্রায় মধ্যরাতেরও পরে তিনি অক্ষত অবস্থায় নিজ বাসায় ফেরেন।

জাহাঙ্গীর হোসেন নামে বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রেস উইংয়ের ওই কর্মকর্তা (পার্সোনাল স্টাফ) দীর্ঘ সময় নিখোঁজ থাকার ঘটনায় মঙ্গলবার ঢাকাস্থ পাকিস্তানের হাই কমিশনার সুজা আলমকে তলব করে প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মঙ্গলবার দুপুরে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলমের সঙ্গে দেখা করেন সুজা আলম। এসময় পররাষ্ট্র সচিব (দ্বিপাক্ষিক) মিজানুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাই কমিশনের কর্মীকে ‘আটকে রাখার প্রতিবাদে’ সুজা আলমের মাধ্যমে পাক সরকারকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।  পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের বিষয়ে  পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুজা আলম সাংবাদিকদের বলেন, “গতকালের ঘটনার বিষয়ে আমাকে জানানো হয়েছে। আমি ইসলামাবাদে কথা বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিস্তারিত জানাব।”

তবে এ ঘটনা দুদেশের সম্পর্কে কোন প্রভাব ফেলবে না জানিয়ে  পাক হাইকমিশনার বলেন, “আগামী দিনগুলোতে এই সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে বলে আমার প্রত্যাশা।”

পাকিস্তানে বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা যায়, ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাই কমিশনের পার্সোনাল স্টাফ (পিও) জাহাঙ্গীর হোসেন সোমবার বিকালে মেয়েকে কোচিং থেকে আনতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি মেয়ের কাছে পৌঁছাননি। দীর্ঘ সময় তার ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর রাত দেড়টার দিকে অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন জাহাঙ্গীর।

তবে তাকে ধরে নেওয়া হয়েছিল কি না, নিলে কারা নিয়েছে- এসব বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।

এর আগে সোমবার দুপুরে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস সেকশনের অ্যাসিটেন্ট প্রাইভেট সেক্রেটারি আবরার আহমেদ খানকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নেওয়ার পর হাই কমিশনের কর্মকর্তাদের জিম্মায়  সন্ধ্যায় ছেড়ে দেয়।

পুলিশের অভিযোগ তার কাছে অবৈধভাবে রাখা ভারতীয় রুপি পাওয়া গিয়েছিল। তবে সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এই ঘটনার নিন্দা জানায় পাকিস্তান হাই কমিশন। এমনকি ওই কর্মকর্তাদের জোরপূর্ব আটক করে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করার অভিযোগ তোলে পুলিশের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশন কর্মকর্তাদের জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক শিথিল পর্যায়ে রয়েছে। তারই মাঝে দূতাবাসকর্মীদের নিয়ে পাল্টাপাল্টি এই ঘটনা ঘটলো।

সোমবার রাতে পাকিস্তান হাই কমিশনের দেওয়া বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ‘অপবাদ ও মিডিয়া ট্রায়ালের’ পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান হাই কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এভাবে হেনস্তা করার এই ধরনটি দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে পাকিস্তানের দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে আসছে  বাংলাদেশের পুলিশ।

গত বছরের জানুয়ারিতে পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা মাযহার খানকে জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত সন্দেহে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর বছরের শেষ দিকে জঙ্গি ‘যোগসাজশের’ অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে  প্রত্যাহার করা হয় আরেক পাকিস্তানি কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে।

সে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়  বিনা ‘অপরাধে’ পাকিস্তানও বাংলাদেশের সিনিয়র কূটনীতিক মৌসুমি রহমানকে সে দেশ থেকে ফেরত নেওয়ার অনুরোধ জানায়। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ওঠে।


‘সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে ভাবছে না সরকার’

এদিকে দুদেশের সম্পর্কে কিছুটার টানাপোড়ন থাকলেও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি ভাবছে না সরকার।

এ বিষয়ে মঙ্গলবার সংসদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘সম্পর্কের টানাপোড়েন কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। টানাপোড়েন হলেই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে- এমন নয়। যুদ্ধের সময়ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকে। পৃথিবীতে এমন অনেক নিদর্শনও আছে।’

‘তাই আপাতত পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু করতে চাচ্ছি না’- বলেও সংসদকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী।

জাতীয় সংসদে এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থকে মাথায় রাখতে হবে। সে কথা চিন্তা করেই আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সর্ম্পক মূল্যায়ন ও পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য।’

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দুদেশের মধ্যে যাই ঘটুক না কেন, তা কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করা উচিত; সম্পর্ক ছিন্ন করে নয়।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশে যা যা ঘটছে তা অনাকাঙ্খিত। তবে সকল সমস্যার সমাধান কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করতে হবে। হুট করে সম্পর্ক ছিন্ন করার মত কঠোর সিদ্ধান্তে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এক্ষেত্রে সরকার সঠিক অবস্থানে আছে বলেই আমি মনে করি।’

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, ‘পাকিস্তান হাইকমিশন ঢাকায় বসে যা করছে, কোনভাবেই তা ঠিক নয়। জঙ্গিবাদসহ বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে তাদেরকে জবাব দিতে হবে। পাকিস্তানকে বিভিন্ন ফোরামে জবাবদিহি করার জন্য, যা যা করার তা করতে হবে। সম্পর্ক ছিন্ন না করলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো লিমিটেড পর্যায়ে আনতে হবে।’

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।