বিডিএইচএস জরিপ, কিছু তথ্য আশা জাগানিয়া, কিছু শঙ্কার
2015.05.08

শিশু মৃত্যুর হার কমানোয় বাংলাদেশের অব্যাহত সফলতার ধারা গত তিনবছর ধরে অক্ষুন্ন আছে। কিন্তু ধাক্কা খেয়েছে সারাবিশ্বে প্রশংসিত ও অনুকরণীয় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি। গত তিনবছরে শিশুদের টিকা নেওয়ার হার পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
সরকারের জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) প্রকাশিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১৪ প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সন্তান প্রসবের আগে চিকিৎসকসহ অন্যান্য প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে নারীদের পরামর্শ নিতে যাওয়ার হার বেড়েছে। উন্নতি হয়েছে পুষ্টি পরিস্থিতির। কিন্তু পিছিয়ে আছে পরিবার পরিকল্পনা সেবা। অল্পবয়সে নারীদের মা হওয়ার হারও কমেনি।
গত ২৪ এপ্রিল রাজধানীর একটি হোটেলে জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি ওই অনুষ্ঠানেই পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নূর হোসেন তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি আপনার মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সক্রিয় করেন।’
‘আমরা জরিপের ফলাফলে সন্তুষ্ট নই। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের তুলনায় অগ্রগতি কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই’, বেনারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. শাহনেওয়াজ ।
প্রতিবেদনটিতে দেশের সব জেলার ১৭ হাজার ৩০০ পরিবার এবং ১৭ হাজার ৮৬৩ নারীর তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়।
প্রসঙ্গ মাতৃস্বাস্থ্য ও অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব: ২০১১ সালের জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল মায়েদের মধ্যে সন্তান প্রসবের আগে চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে চেক-আপ এ যাওয়ার হার ছিল ৪৩ শতাংশ। এই হার তিনবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ শতাংশ।
ধনী-দরিদ্র পরিবারের মধ্যে সন্তান প্রসবের আগে সেবা নেওয়ার হারের যে বৈষম্য তা-ও ৫৭ শতাংশ থেকে ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবের হার ২৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছে। কিন্তু অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার বাড়ছেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১০০ টির মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫টি গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। গত ১০ বছরে এই হার ৪ শতাংশ থেকে ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এখন প্রতি ১০টি শিশুর ৬টিরই জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।
‘প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে দক্ষ ও অদক্ষ হাতে অস্ত্রোপচার হচ্ছে। মা’র জীবন হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে বেঁচে যাচ্ছে। কিন্তু অদক্ষহাতে অস্ত্রোপচারের কারণে তাঁকে সারাজীবন ভুগতে হচ্ছে নানা শারীরিক সমস্যায়,’ বেনারকে জানান সরকারের মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীর উপকর্মসূচী ব্যবস্থাপক আবদুল আলীম ।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সরকার পরীক্ষামূলকভাবে কোনো কোনো জায়গায় পারটোগ্রাফ পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করেছে। এ পদ্ধতিতে প্রসবের নির্দিষ্ট সময় আগে থেকে গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর সার্বক্ষণিক অবস্থা দেখা হয়।
স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে অল্পবয়সে সন্তান জন্ম দেওয়াকে। এ হার কমেনি। জরিপের তথ্য হলো, ৩১ শতাংশ কিশোরী মা হচ্ছে। এই হার দরিদ্র পরিবারগুলোয় ৪১ শতাংশ পর্যন্ত।
শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, নবজাতকরা এখনো ঝুঁকিতে: স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১৪ বলছে, একটি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং জীবনমান সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে শিশু পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা দরকার। সে কারণে গবেষকরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন শিশুস্বাস্থ্যের দিকে।
বাংলাদেশের জন্য এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচবছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার প্রতিহাজার জীবিত জন্মে ৪৮। নতুন প্রতিবেদনে এই হার ৪৬। কিন্তু সামগ্রীকভাবে শিশু মৃত্যুর হার কমলেও ০ থেকে একবছর বয়সের শিশুদেও মৃত্যু হার কমছেনা। পাঁচবছরের নীচে যত শিশু মারা যাচ্ছে তার ৬১ শতাংশই জন্মের একবছরের মধ্যে বিভিন্ন কারণে মারা যাচ্ছে।
‘সংক্রমণ, জন্মকালীন শ্বাসরোধ, সময়ের আগে জন্ম হওয়া ও জন্মগত ত্রুটি আছে যেসব শিশুর মূলত তাদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে,’ বেনারকে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সরকারের হেল্পিং বেবিজ ব্রিদ কর্মসূচীর প্রধান প্রশিক্ষক সঞ্জয় কুমার দে ।
তিনি জানিয়েছেন, আলাদা আলাদাভাবে সমস্যাগুলো মোকাবেলায় বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি।
এ দিকে শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা মনে করছেন শিশুদের টিকা নেওয়ার হার কমে যাওয়ার যে চিত্রটি পাওয়া যাচ্ছে তা দুঃখজনক। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব রোধের প্রধাণতম কারণ ইপিআই কর্মসূচির সফলতা।
স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপে বলা হচ্ছে জন্মের প্রথম বছরের মধ্যে ৭৮ শতাংশ শিশু সবগুলো টিকা পেয়েছে এমন হার ২০১১ সালের তুলনায় পাঁচ শতাংশ কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকা নিয়ে অসুস্থতা ও মৃত্যুর গুজব টিকা নিতে নিরুৎসাহিত করেছে মানুষকে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ও টিভিতে গুজব প্রচার হয়েছে, যদিও স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শিশুর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখে বক্তব্যের সত্যতা পায়নি।
পুষ্টির অবস্থা ভালো, এক জায়গায় আটকে আছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি: গত তিনবছরে খর্বকায় শিশুর হার ৪১ শতাংশ থেকে কমে ৩৬ শতাংশ হয়েছে। কৃশকায় শিশুর হারও ১৬ শতাংশ থেকে কমে ১৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে তীব্র অপুষ্টির শিকার হলে শিশুরা বয়সের তুলনায় খর্বাকৃতির হয়।
১০ বছর আগে দেশের প্রায় অর্ধেক শিশু খর্বাকৃতির সমস্যায় ভুগছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে খর্বাকৃতি ও কৃশকায় শিশুর সংখ্যা কমার অর্থ দেশের দারিদ্র হ্রাস ও সম্পদ বৃদ্ধি এবং শিক্ষিত মা-বাবার সংখ্যা বাড়া।
তবে জরিপ বলছে, ছয়মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার কমেছে।
জরিপে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘আটকে পড়া’ পরিস্থিতি দেখা গেছে। দেশে মোট প্রজনন হার এখন ২ দশমিক ৩। অর্থাৎ একজন নারী ১৫-৪৯ বছর বয়সের মধ্যে ২ দশমিক ৩ শতাংম শিশুর মা হতে পারবেন।
২০১১ সালেও এই হার ছিল একদম একই। সে সময় ২০১৬ নাগাদ প্রজনন হার ২ এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে জরিপ থেকে।