পাকিস্তানের অভিযোগ, আলোচনা ছাড়াই ওআইসির ‘ঢাকা ঘোষণা’ গৃহীত, বাংলাদেশের প্রত্যাখ্যান

জেসমিন পাপড়ি
2018.05.07
ঢাকা
ঢাকায় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫ তম সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন মহাসচিব ইউসুফ আল ওথাইমিন। ঢাকায় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫ তম সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন মহাসচিব ইউসুফ আল ওথাইমিন। ৬ এপ্রিল ২০১৮।
সৌজন্যে: তথ্য অধিপ্তর

মুসলিম প্রধান ৫৭ দেশের জোট ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুই দিনের বার্ষিক বৈঠক শেষে প্রচারিত ঢাকা ঘোষণায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ৩৯ দফার ওই ঘোষণায় রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নৃশংসতাকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

গত রোববার ঢাকায় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫ তম সম্মেলন শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। সম্মেলন শেষে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা তদন্ত করতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটি গঠন করছে ওআইসি।

ওই কমিটি নিরাপত্তা পরিষদসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং বেসরকারি সাহায্য সংস্থাসহ বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে অপরাধের বিচারের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কাজ করবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে ওআইসি সম্মেলন আয়োজন এবং ঢাকা ঘোষণায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ গুরুত্বারোপ মোটামুটি ইতিবাচক। তবে সংগঠন হিসেবে ওআইসি রোহিঙ্গা ইস্যুতে খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে কিনা জানি না”

“তবে বিশ্ব জনমত গড়তে ওআইসি জোরালো ভূমিকা নিতে পারে এবং মানবিক সহায়তাও দিতে পারে,” জানান হুমায়ুন কবির।

ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাঁদের আদি নিবাস রাখাইনে ফেরত পাঠাতে নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ওআইসি।

গত শনিবার ঢাকায় এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ওআইসি দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। সম্মেলনের আগে গত শুক্রবার ওআইসিভুক্ত দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা কক্সবাজারের বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখেন।

সম্মেলন থেকে ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের যে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তা ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তাঁদের নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ওআইসি মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান রেখেছে।

“ওআইসি আসলে ওই রকম কোনো সংগঠন নয় যে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে; তবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা, দেশগুলোকে নিয়ে এ ব্যাপারে জনমত তৈরি করতে কাজ করতে পারে,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।

তাঁর মতে, এ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলাদা সেশন হয়েছে, সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা ক্যম্পগুলো পরিদর্শন করেছেন। এই ইস্যু নিয়ে তাঁদের হয়তো বিক্ষিপ্ত ধারণা ছিল, এখন পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের জন্য মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটি

গতকাল সকালে ওআইসির মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের বিশেষ অধিবেশনে গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচার মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নৃশংসতাকে আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব দেন। তাঁর দেওয়া ওই প্রস্তাবটি বিকেলে সংশোধনীসহ গৃহীত হয়েছে।

প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে ওআইসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি কাজ করবে।

সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে ওআইসির মহাসচিব ইউসুফ আল ওথাইমিন বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তা ছাড়া মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এসময় বলেন, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর পরোক্ষভাবে হয়তো চাপ দেওয়া যাবে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে কতটা চাপ তারা দিতে পারবে এবং সেটা কতটুকু কার্যকর হবে সেই প্রশ্ন থেকে যায়।

পাকিস্তানের অভিযোগ, বাংলাদেশের প্রত্যাখ্যান

​ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন শেষে প্রচারিত ঢাকা ঘোষণা নিয়ে পাকিস্তান বলছে, স্বাগতিক বাংলাদেশ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা কিংবা দর-কষাকষি করে ঢাকা ঘোষণা প্রচার করেনি। তবে পাকিস্তানের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ।

গতকাল দুপুরে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, স্বাগতিক দেশ সম্মেলন শেষ হওয়ার ঠিক আগে ঢাকা ঘোষণা প্রচার করেছে। এতে শুধু স্বাগতিক দেশের দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাই এর দায় স্বাগতিক দেশকে নিতে হবে, কেননা ঘোষণার সারবস্তু নিয়ে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা কিংবা দর কষাকষি করা হয়নি। ওই ঘোষণা, পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ফোরাম এবং সম্মেলনের দলিলসহ ওআইসির দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করেছে।

পাকিস্তানের ওই অভিযোগের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল সোমবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ঢাকা ঘোষণার মূল খসড়া ওআইসি সচিবালয় তৈরি করেছিল। পরে কিছু সদস্য দেশ, ওআইসির সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং স্বাগতিক দেশের পরামর্শে অতিরিক্ত অনুচ্ছেদ এতে সংযোজন করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে গৃহীত হওয়ার আগে পরামর্শগুলো যুক্ত করা হয়। তবে পাকিস্তান ঘোষণার ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে তাতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

“ঢাকা ঘোষণা নিয়ে যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে তা কিছুটা হলেও হতাশাজনক। এর মাধ্যমে ওআইসির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে বিভেদ আছে, তা প্রমাণ করে,” বেনারকে জানান ড. দেলোয়ার হোসেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।